কুণ্ঠা আর লজ্জার আত্মকথন
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
গণ বা সামাজিক যে মাধ্যমেই হোক প্রকাশিত বা প্রচারিত অনেকের লেখাই পড়ি। যেহেতু শেখার নিমিত্তে পাঠ করার ‘বদঅভ্যাস’টি ছোটবেলা থেকেই ঘাড়ে চেপে বসেছে, তখন আর কী করার। ছোটবেলায় এ অভ্যাসের কারণে আমার বাবা কথা শুনতেন। অনেকেই বাবাকে বলতেন, ছেলে যে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ‘আউট বই’ পড়া শুরু করেছে, গোল্লায় যাবে তো। বাবা এসব কথার মুখে হাসতেন। বাবার সেই হাসিমুখের সামনে বলিয়েরা ভবিষ্যতে যে আমার দ্বারা কিছু হবে না দৃপ্তমুখে তারই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। তাদের কথা অবশ্য ফলেছে। হতে পারিনি কিছুই। বয়স এখন মধ্যগগণে, এ বয়সে অনেকে তো ব্যাংকের মালিকই বনে গেছেন! আর নিজ ব্যাংক ব্যালেন্স প্রায় শূন্যের কোটায়। এককথায় অর্থনীতির পরীক্ষায় ডাহা ফেল ছাত্র। ‘বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান’ হীরক রাজার এমন বাক্যটি আমাদের কারও কারও ক্ষেত্রে অমোঘ।
নিজের কথা সাধারণত খুব বেশি বিখ্যাত হলে লেখা হয়। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ লেখার যোগ্যতা যোগ্যতর মানুষেরই। সেদিক দিয়ে আমার এই আত্মকথন যোগ্যতার কোনো মাপকাঠিতেই পড়ে না। তবু এই অযোগ্য লেখা আমার এক প্রিয়ভাজনের জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটি মনছোঁয়া ‘স্ট্যাটাসে’র প্রতি উৎসর্গকৃত। আমার সে প্রিয় ভাইটিও গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত এবং সেখানে সে ভালো করছে। তা সত্ত্বেও তার বক্তব্যে উঠে এসেছে হতাশার রূঢ়তা। অসৎ ও অযোগ্যদের অবস্থান ও আস্ফালনে ক্ষুব্ধ আমার সে ভাইটি। এসব ক্ষেত্রে তার হতাশা ও প্রশ্নকে ঘিরেই নিজের এই আত্মকথন।
সফলতা ও স্বার্থক্যতার প্রশ্নে আমার অনেক লেখা রয়েছে। ‘সফল’ আর ‘স্বার্থক্য’ এ দুটির শব্দের দূরত্ব ও নৈকট্য বিষয়ে আগেও অনেক ব্যাখ্যা করেছি। আজ নতুন করে করার আর ইচ্ছা নেই। কারণ এখন যেদিকে তাকাই সেদিকেই সফল মানুষের মুখ। যদিও স্বার্থক মানুষের দেখা মেলে কদাচিৎ। কিন্তু এখন তো সফলতাই মুখ্য, আর সব গৌণ। এখন রিকশায় বেরোলেই ‘প্র্যাডো’র সঙ্গে দেখা হয়। নিতান্ত অবহেলায় কখনো সখনো প্র্যাডোর জানালা খুলে উঁকি দেয় উৎসুক মুখ; বলে, ভালো আছেন তো। কাঁচুমাচু রিকশায় বিব্রত মুখে বলি, এই তো। মাঝেমধ্যে ‘বিএমডব্লিউ’ অবজ্ঞায় কাদা ছিটিয়ে চলে যায়, যেন বলে যায়, ওই ভাঙা রিকশা তোর ছায়াও যেন না পড়ে আমার উপর। সফলতার এমন সৌকর্য্যে আমি কুণ্ঠিত হই, লজ্জিত হই। কেন হই তা পরে বলি। আগে রিকশায় পাশে বসা স্ত্রী বা কোনো বন্ধুর কুণ্ঠার কথা বলি, লজ্জার কথা বলি। এদেশে এখনো স্ত্রীর পরিচয় স্বামীর নামাঙ্কনে। স্বামীর সফলতায় স্ত্রীর গর্ব। স্বামীর যশে স্ত্রীর গৌরব। সেই অর্থে ‘প্র্যাডো’র সামনে স্ত্রী কুণ্ঠিত, ‘বিএমডব্লিউ’র অবজ্ঞায় লজ্জিত। আর বন্ধু? ‘প্র্যাডো’র কাচে কুচকে যাওয়া নিজ প্রতিচ্ছবিতে তার কুণ্ঠা, ‘বিএমডব্লিউ’র জানালায় নিজের শূন্য চোখ দেখে লজ্জা।
এখন নিজের কুণ্ঠা আর লজ্জার কথা বলি। নিজের কুণ্ঠা স্বার্থকতার ক্রমশ ম্লান হওয়া মুখচ্ছবিতে, আর লজ্জা সফলতার দন্ত বিকশিত অর্থহীন হাসিতে। না আমি সফলতাকে খাঁটো করে দেখছি না, বলছি না যে চোর ডাকাতও সফল হয়ে যেতে পারে, ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করে নিজের রিজার্ভ বাড়াতে পারে। আমি বলছি না, পঁচিশ কোটির রাস্তা দুইশ কোটিতে বাড়িয়ে নিজের অভাব কাটাতে পারে। আমি বলছি না, দফায় দফায় বাড়তে পারে প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স। আমি এসবের কিছুই বলছি না। আমি শুধু বলছি অর্থহীন সফলতার কুণ্ঠার কথা, স্বার্থক না হওয়ার লজ্জার কথা।
‘স্বার্থক’ শেখ সাদিও লজ্জা পেয়েছিলেন ‘সফল’ না হওয়ার জন্য। ঝলমলে পোশাক না থাকায় রাজপ্রাসাদে তার জায়গা হয়নি। সান্ত¡না পাই শেখ সাদিই বাদ যাননি, আমি তো কোন ছাড়। মাঝে মধ্যে আশার আলোও জ্বলে ওঠে, সাহসও পাই। যেমন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, স্বার্থক হবার কথা, সফলতার পেছনে না দৌড়ানোর জন্য। তিনি বলেন, স্বার্থক হলে সফলতা তার পেছনে দৌড়াবে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবার একটি ব্যাংক থেকে সম্মাননা পেলেন, যার মূল্যমান প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। আমি আশান্বিত হলাম। স্ত্রীকে বললাম, দেখ আমার প্রিয়জন স্বার্থক মানুষ, তাই সফলতা তার পেছনে দৌড়িয়েছে।
স্ত্রী মুখ কুচকে বলল, তুমি তো স্বার্থকও নও, সফল তো নও’ই। তুমি হলে ‘দরকাঁচা’ কলা, যেটা তরকারিতেও লাগে না, এমনিতেও খাওয়া যায় না। ঠিকই তো! আপাতদৃষ্টিতে তেমন সম্মাননা পাবার ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই, হয়তো যোগ্যতাও নেই। বয়সও পারমিট করে না নতুন করে সফল হবার ‘ইঁদুর দৌড়ে’ যোগ দেবার। কৈশোর ও যৌবনে আমার ‘আউট বই’ পড়া দেখে যারা ভবিষদ্বাণী করেছিলেন, ‘গোল্লায় যাবে তো’। তারাই হয়তো সঠিক ছিলেন! আমার বাবার হাসিমুখটাই হয়তো ছিল ভুল! হয়তো আমি গোল্লায়ই গেছি! অতএব কী আর করা।
ফুটনোট: গিতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ‘মোক্ষযোগ’ বিষয়ে বাসুদেব বলেন, ‘নিত্যকর্ম পরিত্যাগ করা কর্তব্য নহে; কিন্তু মোহবশত যে নিত্যকর্ম ত্যাগ, তাহা তামস বলিয়া পরিকীর্তিত হয়। নিতান্ত দুঃখজনক বলিয়া কায়ক্লেশ ও ভয়প্রযুক্ত যে কর্ম পরিত্যাগ করা, তাহা রাজস ত্যাগ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। রাজসত্যাগী পুরুষ ত্যাগফল লাভে সমর্থ হয় না।’
সেই অনুযায়ী সন্যাসও আমাদিগের মতোন অভাগাদের অধরা, আমরা সন্যাসেরও যোগ্য নহি। আমাদিগের মতোন যাহারা স্বার্থকতার পথে দৌড়াতে গিয়া সব গুলাইয়া ফেলিয়াছে, সর্বোপরি সফলতার ঠিকানাও যাহাদের জানা নেই, তাহাদের কপালে অশেষ দুর্ভোগ ছাড়া আর কি-ই বা থাকিতে পারে। স্ত্রীর ‘ক্যাটক্যাট’, সন্তানাদির ‘ভর্ৎসনা’ সহযোগে ‘দুর্গতি’ই তাহাদের অবশ্যসম্ভাবী ভাগ্যলিখন। আমাদিগের জন্য ‘হীরক রাজা’ প্রদেয় অমোঘ বাণীই সত্য, ‘বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান; পড়ালেখা করে যে, অনাহারে মরে সে’!
সম্পাদনা: আশিক রহমান