না, শেষ করো না, শুরুতে খেলা…
ফাহমিদা হক
এত আলো পৃথিবীতে তবু অন্ধকারে কেন ডুবে পৃথিবীর মানুষগুলো? কারণ বহু বিচিত্র উপাদানে গড়া মানুষের মন। কখন কি চায় বলা বড় কঠিন। কোন কারণে কি চায় সে তো নিজেই বুঝতে পারে না। মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে তাই কেউ কেউ একান্ত বেদনায় বলে, এ কি হলো কেন হলো, এতো আমি চাইনি। কিছু কিছু পাওয়া এমনই, কারণ মানুষ মাত্রই ভুল করে ভুলে যায়। কষ্ট পাওয়ার, ভুল করার, আঘাত পাওয়ার জন্য হাজারটা কারণ থাকবেই, তাই বলে জীবন যেমন থেমে থাকে না, কিছু ভুলও জীবনকে ক্ষমা করে না। তাই যতটুকু সম্ভব কিছু নীতি কথা মেনে চলা উচিত। যেমনÑ সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
আজকের দিনে সমাজের সবচেয়ে সর্বনাশা বিপদ হলো মাদক। যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। একটু ভালো করে তাকালে আমরা দেখতে পাব মাদক নামক মরণ নেশার জাল এমনভাবে বিছিয়ে আছে যা থেকে মুক্তি পাওয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন একটি বিষয়। এ রকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে কেউ স্বীকার করুক বা নাই করুক এটা অস্বীকার করতে পারবে না যে, এই কঠিন সমস্যা মোকাবিলায় কাউকে একা নয়, গোটা সমাজ, রাষ্ট্র আর সকল জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। সোচ্চার হতে হবে সকলকে মাদকবিরোধী আন্দোলনে। এতটুকু সচেতনতা জাগিয়ে তোলা সময়ের দাবি মাত্র। আজ আমি নিজ চোখে দেখা কয়েকটি অন্ধকার জীবনের ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা তুলে ধরতে চাইÑ
ঘটনা ১: মাদকের বিষাক্ত ছোবলে কেড়ে নেওয়া টগবগে তরুণ, নাম জয়। দেশের একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেধাবী এই তরুণ মাত্র ৩২ বছর বয়সে মাদকাসক্ত জীবনের গ্লানি নিয়ে পরপারে ঠিকানা গড়ে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেটি আপন বড় বোনের কাছে থাকত, ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরুতেই মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকা আসক্তি একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং বোনের কাছে ধরা পড়ে। অকপটে স্বীকার করে তার অন্ধকার জীবনের গল্প কিন্তু নিয়তি তাকে ক্ষমা করেনি; যথারীতি আমাদের সমাজে যা হয়, বোনের বকাঝকা, তিরস্কার আর ঘৃণার পাহাড় ছুঁড়ে মারে ভাইয়ের দিকে। এত অপমানের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওই রাতেই আবেগী ছেলেটা গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে। খুব ভোরে জয়ের বোনের ফোনটা আমি হয়তো কোনোদিনই ভুলতে পারব না। এমন মৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না।
ঘটনা ২: অন্ধকারে নিমজ্জিত আরেকটি পরিবার মুখলেছ সাহেবের (ছদ্মনাম)। তিনি আমার এক সময়ের প্রতিবেশী ছিলেন। উনার বউয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। মুখলেছ সাহেব পল্লীবিদ্যুতে চাকরি করেন একটি ভালো পোস্টে। বউ নামকরা ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষক। এক ছেলে এক মেয়ের সংসার। পুরোপুরি আসক্তিতে ডুবে থাকা মুখলেছ সাহেবকে দেখলে মনে হবে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। গুরুগম্ভীর কম কথা বলা আপাদমস্তক এক ভদ্রলোক। একদিন গভীর রাতে আমাদের দরজায় ভদ্রমহিলা দুই বাচ্চাসহ একটু আশ্রয়ের জন্য করুণ মিনতি দেখে প্রথমে অবাক হলেও বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমি আশ্রয় দিই এবং সব ঘটনা শুনে মনে হচ্ছিল নরক যন্ত্রণা হয়তো এর চেয়ে কঠিন কিছু না। মাদকাসক্ত লোকটার অমানবিক আচরণ সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করলেই সে বাচ্চাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। উনাদের ১২ বছরের মেয়েটি আমাকে বলছিল, আন্টি কোনোদিন শুনতে পাবেন আমাদের কেউ একজন খুন হয়ে যাব। বাবার পাগলামি দেখে ছেলে-মেয়ে দুটোই আচরণে একটু অসুস্থ প্রায়। এই মুহূর্তে এরা কেমন আছে আমি জানি না।
ঘটনা ৩: সংকট জয়ী এক পিতার নাম শাহেদুল ইসলাম হেলাল। প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী নেতা, সমাজের পরিচিত এক নাম। বিদেশে পড়াশোনা করা দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। অন্য আর দশজনের মতোই বাচ্চাদের নিয়ে সুখী সংসারের ছন্দপতন ঘটে যখন জানতে পারেন উনার ছেলেরা মাদকাসক্ত। প্রথমে ভেঙে পড়লেও নিজেদের মধ্যেকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে নিজেদের পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ করে উনারা পরিকল্পিতভাবে মাদকাসক্ত ছেলেদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লেগে যান। আত্মীয়-স্বজনসহ চারপাশের লোকজনদের হাজারো মন্তব্য উপেক্ষা করে খোলামেলা আলোচনা করেই পরিবারের সহযোগিতায় কঠিন এই যুদ্ধে নেমে পড়েন। কোনো লুকোচুরি না করে গোটা চিত্র তিনি টেলিভিশনের মাধ্যমে খোলামেলা আলোচনা করতে থাকেন। নেমে পড়েন জনসচেতনতা তৈরির কাজে। অন্যান্য ভুক্তভোগীদের পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। পাশাপাশি এক নিরলস সংগ্রাম আর ভালোবাসায় উনি দুই ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
ওনার ছেলেরা সম্পূর্ণ ভালো হয়ে উঠতে পেরেছে ওনার এবং পরিবারের অকুণ্ঠ বিশেষ করে ছেলেদের ভালো হবার আগ্রহ এবং সহযোগিতায়। বর্তমানে হেলাল ভাই, ভাবী দাদা-দাদী হয়েছেন। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো যে মাদকে আসক্তদের এমন ঝলমলে জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। আমি মনে করি, হেলাল ভাইদের দৃষ্টান্ত অনুকরণীয়। উনি প্রমাণ করে দিয়েছেন মাদকাসক্তরাও পরিবার তথা চারপাশের সবার সহযোগিতা পেলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারে। শুধু মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারসহ চারপাশের মানুষের দৃঢ় মানসিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ই একজন মাদকাসক্তের জীবনকে অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখাতে সক্ষম। হেলাল ভাইকে অভিনন্দন, তিনিই বাংলাদেশে প্রথম মাদককে ঘিরে লুকোচুরি ও নীরবতার দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন। যেকোনো মাদকাসক্ত কিংবা তাদের অভিবাবক সাহায্যের জন্য এই ভালো মানুষটির স্মরণাপন্ন হতে পারেন। হেলাল ভাই এখন ঢাকায় একটি আধুনিক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র চালু করেছেন। তিনি সবসময় মনে করিয়ে দেন মাদকাসক্তি কোনো অপরাধ নয়, এক ধরনের অসুস্থতা।
সম্প্রতি একটি জরিপে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, মাদকাসক্তদের শতকরা ৬৫ জনই শিক্ষিত এবং এদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই অতিমাত্রায় আসক্ত। একই জরিপে আরও বলা হয়েছে এদের মধ্যে শতকরা ৩৫ জন বিবাহিত, শতকরা ১০ জন সংসার বিচ্ছিন্ন, শতকরা ৪০ জন বেকার, শতকরা ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী, শতকরা ১৫ জন ব্যবসায়ী এবং বাকি ২০ জন অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। তথ্যমতে আরও জানা যায়, এই মাদকাসক্তদের শতকরা ৮৫ জনই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত। যেটা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের তা হলোÑ নারী, পুরুষ, শিশু, বয়োবৃদ্ধ, ধনী, গরিব কেউই মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী মাদকের এই সর্বনাশা নেশা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কারণ মাদকের অবৈধ পাচার দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টে অতি সহজে। মাদকের এই ক্রমবর্ধমান বিস্তার বেড়েই চলছে। কেননা এর সহজ প্রাপ্যতা ও আবেগ। যার ফলে সমান তালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়। যার কারণে জাতিসংঘের ‘ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ দফতর থেকে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে সংঘবদ্ধ হয়ে সকল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে মাদকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার। ভয়ংকর এই প্রবণতা রোধ করতে শুধু নিরাময়মূলক ব্যবস্থা নয়, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে প্রথমত পিতা-মাতা, শিক্ষক ও পরিবারের লোকজন। তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, গণমাধ্যমও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
যেহেতু মাদকাসক্তি এক ধরনের রোগ এবং এটি একটি সামাজিক ব্যাধি, তাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে অবহেলা, ঘৃণা, তিরস্কার বা অসম্মান না করে অসুস্থ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে পরিবারসহ চারপাশের সমাজের সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। এই সমস্যা ব্যক্তির একার নয়, গোটা পরিবারের, রাষ্ট্রের, সমাজের সকলের। ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই কঠিন সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব।জীবনের ব্যাকরণ সবসময় নিয়ম মেনে চলতে পারে না। জীবন এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। এই পথ কখনো আঁকা-বাঁকা, কখনো এতে নানা চড়াই উৎরাই থাকে। জীবনের নানা রং রয়েছে, এর সৌন্দর্য অতুলনীয়। তাই কোনো হতাশা নয়, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান নয়, জীবনকে ভালোবেসে জীবনকে সাজাতে হবে। কারণ আমরা কেউই জানি না জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে, হয়তো ভালো কিছু! আর তাই, মাদকে আসক্ত হয়ে শুরুতেই যেন কেউ জীবনের খেলাটা শেষ করে না দেন।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান