বাজেট বরাদ্দের সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় না করা অদক্ষতা নয়
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার বরাবর প্রতিবছর নিজ নিজ ব্যয়ভার মিটানোর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুরের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ওপর ন্যস্ত। আমাদের দেশে অর্থবছর ১ জুলাই শুরু হয়ে ৩০ জুন শেষ হয়। প্রতিবছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক বাজেট প্রস্তুতের আগে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা হতে আসন্ন অর্থবছরে ব্যয় বিষয়ে চাহিদাপত্র দিতে বলা হয়। বাজেট প্রস্তুতকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার চাহিদাপত্র বিষয়ে পৃথক বৈঠক হয় এবং উক্ত বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত চাহিদাপত্র বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনাপূর্বক মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার জন্য বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়। সচরাচর দেখা যায়, চাহিদাপত্রে মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার পক্ষ হতে যেভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয় তাতে এতদবিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বাজেট প্রস্তুত করলেও প্রতিবছর সংসদ অধিবেশনে সংসদ কর্তৃক অর্থবিল আকারে এটি সংসদে উত্থাপনের পূর্বে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। সংসদে বিস্তারিত আলোচনাঅন্তে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে বাজেট পাস হয় এবং পাসঅন্তে এটিকে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তার সম্মতি গ্রহণ করতে হয়।
প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থার প্রধানগণ স্ব স্ব কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা। যেকোনো অর্থ ব্যয় বিষয়ে এরূপ আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হয়। প্রতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত খাতভিত্তিক অর্থ অর্থবছর সমাপ্ত হওয়ার আগেই ব্যয় করে এর বিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়স্থ প্রধান হিসাবরক্ষকের কার্যালয়ে সর্বশেষ ১৮ জুনের মধ্যে দাখিলের বিধান থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা ৩০ জুন অবধি দাখিল করা যায়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তদঅধীনস্থ বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর ও সংস্থা এর বরাবর প্রতি অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ হতে আসে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যয়ের বিধান থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে প্রায়শই তা উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। আবার অনেক আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার মধ্যে এ বিশ্বাসটি কাজ করে যে একটি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় না করা গেলে তা তার জন্য অদক্ষতা হিসেবে বিবেচিত। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এরূপ অনেক কর্মকর্তা নিজের দক্ষতা প্রমাণের জন্য ব্যয়ের যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক তা বিবেচনা না করে যেকোনোভাবে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়াস নেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় না করে যোগসাজশীভাবে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে ভুয়া বিল দাখিলপূর্বক অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। এভাবে অগ্রিম উত্তোলনকৃত অর্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মসাৎ হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তদঅধীনস্থ কার্যালয়সমূহের বরাবর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা বহির্ভূত বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয় ও মেরামত, সভা, সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সংশ্লেষে ব্যয়, দেশ ও বিদেশে ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যয়, এয়ারকুলার, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, টেলিফোন, মোবাইল প্রভৃতি সংক্রান্ত ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় কিভাবে নির্বাহ করা হবে সে বিষয়ে নির্ধারিত বিধানাবলি রয়েছে। সরকারের যেকোনো কার্যালয় বিধানাবলি অনুসরণপূর্বক ব্যয় নির্বাহ করলে ব্যয় সংশ্লেষে কোনো ধরনের অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অধিকাংশ কার্যালয়ের ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা ও নিয়মমাফিক ব্যয় নির্বাহ না করার কারণে অর্থ বছর সমাপ্ত হওয়ার পূর্বক্ষণে দেখা যায় ব্যয় নির্বাহ ব্যতিরেকেই অগ্রিম বিল দাখিলের হিড়িক। এ ধরনের অগ্রিম অনেক বিল যোগসাজশী ও ভুয়া।
সরকারের একটি কার্যালয় কর্তৃক স্ব স্ব নিরীক্ষা বিভাগে বিল দাখিল পরবর্তী তা অনুমোদনের দায়িত্ব উক্ত বিভাগের ওপর ন্যস্ত। এ বিভাগটি বিষয়ে জনমনে এমন বিশ্বাস বিরাজমান যে, বেতন-ভাতা বহির্ভূত অপর যেকোনো ধরনের বিলের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাশামাফিক নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ প্রদান না করলে অযথা সে বিল পাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর যে মুহূর্তে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় তাৎক্ষণিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়।
সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের ব্যক্তিবর্গের অভিমত নিরীক্ষকের কার্যালয়ে বিল পাস বিষয়ে প্রাপ্তি যোগ না থাকলে অযথা যে হয়ারানির সম্মুখীন হতে হয় তা দূরীভূত করা গেলে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে নিরীক্ষকের কার্যালয় কর্তৃক এটি পাস সংশ্লেষে দুর্নীতি লাঘব বহুলাংশে সম্ভব। আর এ কথাটিও ঠিক ব্যয়ের যৌক্তিকতার ভিত্তিতে নিরীক্ষকরা বিল পাস করলে সরকারের যেকোনো কার্যালয় কর্তৃক অযৌক্তিক ব্যয় নির্বাহের অবকাশ ক্ষীণ।
আজ হতে প্রায় চার দশক আগে আমার চাকরিজীবনে প্রবেশকালীন নিজ বিভাগের বিভিন্ন আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার অধীন কাজ করার সময় সরকারি অর্থ ব্যয় বিষয়ে তাদের মধ্যে যে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ করেছি তা বর্তমানে যারা সমদায়িত্বে রয়েছেন তাদের মধ্যে হারানোর পথে। অতীতে আমার নিজ বিভাগের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তাদের মধ্যে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ যৌক্তিকভাবে ব্যয় নির্বাহ পরবর্তী অব্যয়িত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকার বরাবর ফেরত দেওয়ার প্রচলন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল। আজ যেমন বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করে অনেকে দক্ষতা প্রমাণে সচেষ্ট সে সময় বরাদ্দকৃত অর্থের বিশেষত আনুষঙ্গিক খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে কে কত বেশি বাঁচিয়ে তা সরকারের কোষাগারে ফেরত প্রদান করতে পেরেছে এ প্রতিযোগিতায় অনেকে সচেষ্ট ছিল।
সরকারের এমন অনেক কার্যালয় রয়েছে যেগুলোতে সভা, সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সংশ্লেষে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা সংখ্যানুপাতে না হওয়ায় ব্যয় সাশ্রয় হয়। অতীতে এ ধরনের সাশ্রয়কৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রবণতা ছিল। বর্তমানে দেখা যায় ফেরত না দিয়ে খাত পরিবর্তনপূর্বক যথেচ্ছাভাবে ব্যয় করে দক্ষতা প্রমাণের প্রয়াস নেয়।
অতীতে সরকারের একটি কার্যালয়ের জন্য প্রতিষ্ঠাকালীন যে আসবাবপত্র ক্রয় করা হতো প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে তা দিয়ে কয়েক যুগ পার করে দেওয়া হতো। কিন্তু এখনকার কর্মকর্তাদের মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা অনুপস্থিত। এখনকার অনেক কর্মকর্তাই রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ধার ধারেন না। তাদের মানসিকতা এমন প্রতি বছরই প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক কার্যালয়ের জন্য নিত্যনতুন ও চাকচিক্যে ভরপুর আসবাবপত্র চাই।
সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের যে সকল কর্মকর্তা যৌক্তিকতা ব্যতিরেকে ব্যয় নির্বাহে অপরাগ তারাই হলো প্রকৃত অর্থে সততা ও ন্যায়পরতার আদর্শে বলীয়ান দক্ষ কর্মকর্তা। এ ধরনের কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে কম সংখ্যক হলেও তারা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। এদের ওপর যারা অদক্ষতার কালিমা আরোপে যৌক্তিকতার বালাই না করে বাজেটে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়াস নেয় এরা স্ববিবেচনায় দক্ষ হলেও এ দেশের জনমানুষের বিবেচনায় অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। এ সমস্যা হতে উত্তরণের জন্য সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন অতীব জরুরি। আর যতক্ষণ পর্যন্ত এ মানসিকতার পরিবর্তন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ দেশের সাধারণ জনমানুষের কর এর মাধ্যমে প্রদত্ত অর্থের অপব্যয় চলতেই থাকবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান