কুমিল্লায় নৌকাডুবি ও ধানের শীষে হাওয়া
অজয় দাশগুপ্ত
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি তথা ধানের শীষের বিজয় হয়েছে। এ নিয়ে কথা বলা বা লেখার লোকের অভাব নেই দেশে। আমরা যারা দূরে থাকি এবং নিয়মিত দেশের ঘটনার আঁচ টের পাই আমাদের জন্য এটি কোনো বড় খবর না। কারণ এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যাবতীয় উন্নয়ন বা দেশের অগ্রগতির পরও বদলে যাওয়া মনমানসিকতায় এরাই মানুষের মনে জায়গা নিয়ে বসে আছে। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইমেজ আর তার একক নেতৃত্বের বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাদের কর্মকা- কিংবা ভূমিকা মানুষকে নানাভাবে বিরক্ত করলেও তারা তা টের পায় না।
এক শ্রেণির সুশীল ও বুদ্ধিজীবী এখন যত কাঁদুন আর যতই বলুন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা মানে আওয়ামী লীগ এটা কেউ মানে না। না মানার কারণ তাদের খাই খাই মনোভাব। একদিকে যেমন আয়-উন্নতি আরেকদিকে আছে এদের স্বেচ্ছাচারিতা। সাধারণ মানুষ খুব ভালোভাবে জানে চাঁদা ছাড়া কাজ মেলে না। অফিসে-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মাসোহারা এবং নজরানা দেওয়া এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বড় দল বলে তাদের মনোভাবে ছায়া দেওয়ার পরিবর্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও দলীয় ষড়যন্ত্র খুব সাধারণ ঘটনা।
কুমিল্লাতে বিএনপির বিজয়ে বা প্রাপ্ত ভোটে খালি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অবদান আছে এটা ভাবা ভুল। সামাজিক মিডিয়ায় এ যাবত দেখা মন্তব্য আর মতামতে আমি দেখেছি সংখ্যালঘু নামে পরিচিতজনেরাও মহা খুশি। কারণ আদর্শের নামে বা চেতনার নামে আপনি যেমন জোব্বা পরিয়ে রাখতে পারেন না তেমনি কাউকে তার অধিকার বঞ্চিতও করতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে দিকটা হারিয়ে দেশ ও সমাজ আজ নিঃস্ব সে দিকটা আওয়ামী লীগের মাথায় নেই। তারা মনে করে প্রশাসন আর বাহিনী সঙ্গে থাকলেই চলবে। এই একই খেলা খেলতে গিয়ে বিএনপি আজ দেউলিয়া প্রায়। জনগণের পালস বা মনোভাব বুঝতে না পারার বড় কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। সেটা যে কত প্রকট তা এই দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি যে বললেন, দলে কাউয়া ঢুকেছে। এই কাক বা কাউয়া কিন্তু সকালবেলায় ঘুম ভাঙানোর কা কা কাউয়া না। এটা ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কিংবা যেখানে খাবার সেখানে জমায়েত লোভী কাকদের কা কা আওয়াজ। খেতে খেতে আজ এমন এক জায়গায় যাতে মানুষ সুযোগ পেলেই তাদের বিরূপ মনোভাবের জানান দিচ্ছে।
সাক্কু সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়েই বলি, আমরা ভয় পাই অন্য কারণে। দেশে একটা সমান্তরাল পরস্পরবিরোধী রাজনীতি চলছে। জঙ্গির মতো ভয়াবহ বাস্তবতাকে একদল যেমন ফাঁদে না পড়া পর্যন্ত আইএসের কাজ মনে করে না, আরেকদল বলে এটাই চলার কথা। বিএনপি দ্বিতীয় ধারার দল। তাদের আমলে জঙ্গিবাদের হাতে খড়ি। তারা যদি মনে করে থাকে তাদের দেশ শাসনে দেখলেই জঙ্গিরা নিজেরা সাইজ হয়ে যাবে বা বলবে আপনারা আছেন বলে আমরা এসব বাদ দিয়ে ভালো হয়ে গেলাম তবে মারাত্মক ভুল হবে। একটা কথা মনে করিয়ে দিই, আওয়ামী লীগের নেতাদের তুলনায় বিএনপির নেতারা গ্যাটআপে এবং পোশাকে-আচরণে অনেক মডার্ন। তারা লেবাসের জন্য দাড়ি টুপি পরেন না। তাদের এই আধুনিকতা জঙ্গিদের পছন্দ হবার কথা নয়। তারা এদের চাড় দেবে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। কুমিল্লার এই ফলাফল আমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগে মোশতাকদের জায়গা ও ভূমিকা এখনো অটুট। মনে রাখা দরকার, জিয়াউর রহমানকে আপনারা যত গালাগাল করেন আর দোষারোপ করেন তার আগমনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল খন্দকার মোশতাক। সে ইতিহাস থেকে আপনারা যদি কিছু শিখতেন কুমিল্লায় হয়তো হারতেন না।
আর একটা বিষয় দুনিয়ার সব খেলায় সমানে সমান না হলে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না তেমনি না খেলতে খেলতে নিজেদের শক্তিও টের পাওয়া যায় না। যেমন মোহামেডান বনাম আবাহনী। যেমন আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল। যেমন ভারত বনাম পাকিস্তান বা ইংল্যান্ড বনাম অষ্ট্রেলিয়া। এদের খেলায় যেমন মানুষ আমলে পড়ে তেমনি এরা পরস্পর খেলে বলেই টেকনিক জানে, কৌশল বোঝে এবং একজন আরেকজনকে টপকে যায়। আপনি যদি তা না করে ভূটান আর মালদ্বীপের সঙ্গে খেলতে থাকেন, নিজেকে এরশাদের সঙ্গে খেলে বা ওয়াক ওভার নিয়ে জয়ী ভাবেন তখন যেকোনো শক্ত মোকাবিলায় আপনিই হারবেন। কুমিল্লা সেটাই আবার প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। নৌকাডুবির এই সংকেত ধানের শীষে হাওয়া দিলেও জনগণের মনে কি বাতাস বইয়ে দিল সেটা জানাই এখন জরুরি।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান