নৌকার পরাজয়, কার লাভ কার ক্ষতি!
মো. ওসমান গনি
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে। শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কুসিক নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল সারা বাংলাদেশের মানুষ। কি হতে যাচ্ছে এ নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনের জন্য এ নির্বাচন ছিল অগ্নিপরীক্ষা। এ পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন পাস করেছে বটে, কিন্তু মার খেয়েছে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার প্রতীকÑ নৌকা! নৌকা প্রতীক মার খাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী নয়। কেননা নির্বাচন কমিশনের কাছে এ নির্বাচন ছিল তাদের দায়িত্বের সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়। সেই হিসাবকে সামনে রেখেই নির্বাচন প্রধান নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এক্ষেত্রে কোন দল পাস করল আর কোন দল পরাজয় বরণ করল সেটা তার দেখার ব্যাপার না। তিনি এ নির্বাচন সফলভাবে সম্পূর্ণ করতে যা যা করার দরকার ছিল সেটিই তাই করেছেন। এমনকি বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের কাছে তিনি তার নিরপেক্ষতার প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এতে করে যে শুধু নির্বাচন কমিশনের লাভ হয়েছ তা নয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের শাসনামলে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে এবারই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। এ সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনীত প্রার্থী হলেন মনিরুল হক সাক্কু। সীমা এবারই প্রথম মেয়র প্রার্থী। আর মনিরুল হক সাক্কু গত টার্মেও মেয়র ছিলেন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উভয় দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতারা তাদের দলের প্রার্থীদের পক্ষে ব্যাপক প্রচার কাজও চালিয়েছিলেন। কিন্তু গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেখা গেল আওয়ামী লীগ প্রার্থী নৌকার মাঝি আঞ্জুম সুলতানা সীমা তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ধানের শীষের মনিরুল হক সাক্কুর কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করেছেন। অবশ্য এ পরাজয় আঞ্জুম সুলতানা সীমার না। এ পরাজয় হলো নৌকা মার্কার পরাজয়। এ পরাজয় হলো শেখ হাসিনার পরাজয়। এ পরাজয়ের পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা আফজল-বাহার এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কোন্দল চলে আসছিল। অবশ্য সিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর হতে কোন্দল ভুলে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলেও নির্বাচনের মাঠে তার প্রতিফলন হয়নি। যার কারণে দুই নেতা আফজল-বাহারের দ্বন্দ্বের কারণে সীমা নির্বাচনে ফেল করেন। ইতোমধ্যেই তার পরাজয়ের কারণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছেন পর্যবেক্ষকরা। অনেকেই বলছেন, স্থানীয় রাজনীতির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ‘আফজল-বাহারের দ্বন্দ্বের বলি’ হয়েছেন সীমা। আর সে কারণেই পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, কুসিক নির্বাচনে যেসব কেন্দ্রে নৌকার ব্যাজধারী কর্মী বেশি দেখা গেছে সেসব কেন্দ্রেই ধানের শীষের প্রার্থী ভোট বেশি পেয়েছেন। ফলে সংসদের বাইরে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুই কুসিকে দ্বিতীয়বারের মতো নগরপিতা হিসেবে বসতে যাচ্ছেন।
জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আ ক ম বাহারউদ্দিন বাহারের সঙ্গে সীমার পিতা অ্যাডভোটেক আফজাল পরিবারের প্রকাশ্য বিরোধ থাকায় তিনি নির্বাচনে সীমার পক্ষে তেমনভাবে কাজ করেননি। অনেকে অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনের আগে যারা দিনে আফজাল ও সীমার পক্ষে ছিলেন, রাতে তারা সাক্কুর হয়ে কাজ করছেন, আর ভোটের দিন তারা দিনে সীমার নৌকা প্রকীকের ব্যাজ পরে ধানের শীষে ভোট দিয়ে সাক্কুকে বিজয়ী করেছেন।
ফলাফলে দেখা যায়, কুসিক নির্বাচনে ১০৩ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রে ৬৮ হাজার ৭৯৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। তার নিকটতম আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৮ হাজার ২৬১ ভোট। সারাদেশে কুমিল্লার মতো আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। যার ফলাফল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলোÑ গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ৯নং মাইজখার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা মার্কার মনোনয়ন দেন জামাল উদ্দীনকে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির ডা. শহীদ উল্লাহ। উক্ত ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান শাহ সেলিম প্রধান জামাল উদ্দীনের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির প্রার্থী ডা. শহীদ উল্লাহ তার নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে সরে যান। নির্বাচনের মাঠে আছেন নৌকা মার্কার জামাল উদ্দীন ও তার বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান শাহ সেলিম প্রধান। নির্বাচনের দিন কিছু কিছু ভোটকেন্দ্রে নৌকা মার্কার লোকজনদেরকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। ভোটের ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জামাল উদ্দীন বিদ্রোহী প্রার্থী শাহ সেলিম প্রধানের নিকট হেরে যান। ভোটের পরে শুরু হয় জামাল উদ্দীনের নেতাকর্মীদের নামে হামলা ও মামলা। এক্ষেত্রেও নৌকা মার্কার জামাল ফেল করেনি ফেল করেছে শেখ হাসিনা ও শেখ হাসিনার নৌকা। তাই এখনই আওয়ামী লীগকে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। না হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজয় বরণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান