বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষের সেবায় আনসার ভিডিপি
ড. ফোরকান উদ্দিন আহম্মদ
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ড্যান্ট, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি একাডেমি, গাজীপুর
দুর্যোগ যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে মানবচক্ষের অগোচরে অথবা গোচরে ঘটে থাকে। কোনো এলাকা যখন দুর্যোগ কবলিত হয়ে যায় বা দুর্যোগ যখন আচমকা কোনো স্থানে আঘাত হানে তখন মানব প্রচেষ্টায় অর্জিত ফসল, বিনিয়োগ, বিনির্মাণসহ জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট ১৯৯৯-এর হিসাব মতে, বিগত ২০ বৎসরে সংগঠিত বিভিন্ন দুর্যোগের করাল গ্রাসে পৃথিবীতে প্রায় ৫০ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যুবরণ ঘটে, ১৫০ কোটি লোক দুর্যোগ পীড়িত হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে এবং ২০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার মূল্যমানের সম্পাদাদির ক্ষতি সাধিত হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধুমাত্র আমাদের মানবিক প্রচেষ্টাকে হুমকির সম্মুখীন করে না বরং মানবসভ্যতা ও অবকাঠামোতে অসংখ্য বিরূপ প্রভাব ফেলে, যেমনÑ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি লাগসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে মন্থর করে দেয়। বিশেষত এ জাতীয় ক্ষয়-ক্ষতিসমূহ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রকটভাবে দৃশ্যমান এবং এ দেশগুলোর জনগণ দুর্যোগজনিত কারণে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সংগঠিত মৃত্যুর ঘটনা শতকরা ৯০ ভাগ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শতকরা ৯৫ ভাগ সামগ্রিক দুর্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। উল্লেখিত তথ্য জাপানের ইউকোহামায় ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাসকরণ বিষয়ের উপর বিশ্ব সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়। শিল্পোন্নত দেশে এই দুর্যোগে যে ক্ষয়-ক্ষতি হয় তার চেয়ে ২০ গুন বেশি ক্ষতি হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি এবং গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে শিল্পকারখানা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এই ক্ষতিসমূহ সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠন তাদের মেধা, বুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিভিন্নভাবে দুর্যোগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। দুর্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞাগুলো নিম্নরূপÑ ক. যেকোনো ঘটনা যা আর্থিক, জানমাল, স্বাস্থ্যের মান ও সেবাসমূহে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে, সেসব ঘটনার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বহির্ভূত অঞ্চল হতে ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাকেই দুর্যোগ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। খ. দুর্যোগ সমাজের চলৎশক্তি রহিতকরণের অপর নাম যা মানুষ, সম্পদ অথবা পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতিসাধনের উৎস এবং যা ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয় এমন মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। গ. দুর্যোগ হলো প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্য সৃষ্ট আকস্মিক অথবা পর্যায়ক্রমিক এমন ঘটনা যা এমন চরমভাবে ক্ষতিসাধন করে যে, ক্ষতিগ্রস্ত মানবসমাজকে তা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে হয়। নিম্নে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট দুর্যোগের উপরে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হলো:
বন্যা অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমি হতে নিম্ন ভূমিতে পানির প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বন্যাকে প্রধান দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বন্যা নিয়মিতভাবে মৌসুম ও প্রাক-মৌসুম ঋতুতে ঘটে থাকে। বিশ্বে যতগুলো অতিবৃষ্টিপাতের রেকর্ড আছে তার সবগুলো বাংলাদেশে হয়েছে।
সাইক্লোন শব্দটি গ্রিক শব্দ কাইক্লোস হতে উৎপত্তি হয়েছে যার আভিধানিক অর্থ হলোÑ সাপের কু-লি। নিম্নচাপের দরুণ সৃষ্ট তাপ এবং আদ্রতার মিশ্রণে সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। সাধারণত সমুদ্রের যে এলাকায় পানির উচ্চতা ২৬. সেন্টিগ্রেডের উপরে চলে যায় সে এলাকায় নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন ঝড়ো হাওয়া ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি করে এবং গভীরতর নিম্নচাপের চতুর্দিকে এই ঘূর্ণিবলয় সংগঠিত হয়। এই নিম্নচাপই ক্রমে সাইক্লোনে পরিণত হয়ে তার গতিপথে আঘাত হানতে অগ্রসর হতে থাকে। গত ২৫ বছর (১৯৭০-৯৬) সাইক্লোনের ফলে মৃত মানুষের সংখ্যা ৪,৫৭,২০৮ জন। তন্মধ্যে ১৯৭০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ৩ লাখ। ১৯৮৫ সালে ১১০৬৯ জন এবং ১৯৯১ সালে ১,৩৮,৮৬৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১,৭৩,৮১,৯৯৯ জন। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে সংগঠিত সাইক্লোনের ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩,৩৮০০০ মিলিয়ন টাকা এবং ১৯৮৫-এর পরিমাণ ছিল ৯,৪১০ মিলিয়ন টাকা।
মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, যানযট ইত্যাদি। এ ছাড়া বৃক্ষ নিধনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। তথাকথিত এক শ্রেণির বিপদগামী উচ্ছৃঙ্খল যুবকের উচ্চভিলাষ এবং তথাকথিত ভ্রান্ত রাজনীতি ও সন্ত্রাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ ও অনাচার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত করে তুলেছে। উন্নত তথ্য প্রযুক্তির চলমান প্রবাহে বৈদেশিক সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশে বাংলাদেশি এতিহ্যবাহী মনোরম সংস্কৃতি বিলীন হচ্ছে আর ক্রমান্বয়ে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যথেচ্ছ হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, যানযটের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে।
আনসার ভিডিপি একটি তৃণমূল পর্যায়ের বিরাট সংগঠন। এই সংগঠনের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষেরা সংগঠিত হয়ে দেশ ও জাতির দুর্দিনে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বিগত দিনে। যখনই এ জাতীয় সমস্যার উদ্ভব হয়েছে আনসার ভিডিপির সদস্য-সদস্যাগণ এক জোট হয়ে আর্তপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অসহায় মানুষের সহায় হয়েছে। সেবা-সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে উদার মন নিয়ে। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করেছে। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব নিয়ে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটি দুর্যোগের সময়ে তারা কাজ করেছে।
বাংলাদেশ আনসার ভিডিপি বাহিনী ইতোমধ্যেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলায় বন্যার পূর্বাভাস, বন্যা মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি ও বন্যা পরবর্তী ত্রাণ বিষয়ে সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের উপরে উঠান বৈঠক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ছোট ছোট দলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছেÑ যাতে তারা তাদের এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় নিরাপত্তা রক্ষার প্রাথমিক ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে। অন্যান্য জেলায়ও পর্যায়ক্রমে এই প্রকল্পের আওতায় দুর্যোগ মোকাবিলায় কনটিজেন্সি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত গোষ্ঠী তৈরি করা হবে।
বিগত দিনে আনসার ভিডিপি পিছিয়ে না থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষাসহ উন্নয়ন চিন্তাকে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। আনসার ভিডিপি বর্তমানে অনেক অগ্রগতির সিঁড়ি পেরিয়ে ক্রমাগতির দিকে ধাবমান। বর্তমানে এই বাহিনীর সদস্য-সদস্যাগণ প্রশিক্ষিত হয়ে আত্মউন্নয়নের সুযোগ গ্রহণ করেছে, এমনকি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দেশ মাতৃকার উন্নয়ন চিন্তায় ও তারা মনোনিবেশ করছে।
মানব সৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবিলার ব্যাপারে এই বাহিনীর সদস্য-সদস্যাগণকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে প্লাটুন গঠন করে গ্রাম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে এবং অন্যায়, অনাচার, অসাম্য, বিভেদ ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য তৈরি করে সমাজকে কলুষমুক্ত করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। সামাজিক জননিরাপত্তার বিঘœ সৃষ্টিকারী, হঠকারী ও দুষ্ট ক্ষতকে উৎপাটন করে সাবলীল সমাজ গড়ার জন্য এক মহান আদর্শে উজ্জীবিত করার প্রয়াস নিয়েছে বর্তমান সরকার। আর আনসার ভিডিপি আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামীণ মানুষকে সুস্থ সমাজবোধ ও নৈতিকতার আলোকে আলোকিত করে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন আজ আমাদের প্রত্যাশা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রকৃতির এক খেয়ালি সৃষ্টি। তার উপর পার্থিব কোনো শক্তিমানেই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাকে প্রতিরোধ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত হলে অন্ততঃপক্ষে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকবে, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে এবং অল্প সময়েই সংগঠিত ক্ষয়-ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগ প্রতিরোধ করা ততো কঠিন নয়। সমাজ দেহ থেকে এ দুর্যোগের ক্ষয় পরিপূর্ণভাবে মুছে ফেলা সম্ভব হবে। শুধুমাত্র দৃঢ়তা, সততা, আন্তরিকতা, ঐকান্তিক পরিশ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়ের গুণে এ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে সমাজকে সুন্দর ও সাবলীল করে গড়ে তোলা যাবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান