সিভিক সেন্স নাকি ননসেন্স!
অরুণ কুমার বিশ^াস
প্রচলিত আছে, অ্যা ম্যান ইজ হোয়াট হি ইটস! মানুষ তা-ই, যা সে খায়। আমি বলি, ভক্ষণ দেখে লোক চেনা যায়। সবাই কিন্তু খায় না, কেউ কেউ খায়, কেউ ভক্ষণ করে, আবার কেউ স্রেফ গেলে। মানে এর মুখে তোলার ধরন ও চর্বণ মোটেও স্বস্তিকর নয়। একটু খেয়াল করে দেখবেন, গরুর মতো একমুখ খাবার মুখে তুলে নিয়ে সশব্দে কচাকচ চিবিয়ে খাবার অভ্যেস অনেকের আছে। খেতে খেতে বাচালের মতো দেদার কথাও বলে কেউ কেউ। তখন মুখ থেকে খাদ্যকণা ছিটকে এসে পাশর্^বর্তী ব্যক্তির সফেদ পাটভাঙা শার্ট হরিদ্রাভ করে দেয়, আর মনটাকে দেয় বিষিয়ে। এদের আপনি কী বলবেন! সভ্য নাকি ননসেন্স!
রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে অনেকেই এঁটো হাতে নুন-মরিচ-সালাদ তুলে খান। একবারও ভাবেন না, অন্য ব্যক্তিটি আপনার এই জঙ্গুলে আচরণ দেখে কী ভাবছেন! অথচ কাছেই চামচ আছে বা ওয়েটারকে ডেকে একটি চামচ চেয়ে নিলেই পারেন, পুরো নুনের বাটি এঁটো করার কী দরকার!
একশ্রেণির বোকাসোকা মানুষ পাবলিক বাসে উঠে মোবাইলে এমন উচ্চস্বরে কথা বলেন যেন সেলফোনে নয়, সরাসরি ওপারের লোকটির সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন। এদের বেকুব বললে কম বলা হয়, এরা প্রকৃতই মানুষ্যগোত্রীয় কিনা এ ব্যাপারে কিঞ্চিত সন্দিগ্ধ আমরা হতেই পারি। কিংবা ধরুন ওই লোকটি যে কি না বসের সিটে বসে ঘরোয়া আলাপে এমন মশগুল, বউয়ের সঙ্গে কবে তার কী নিয়ে খুনসুঁটি হয়েছে বা শ্যালিকার সঙ্গে মনোমালিন্য, সব হাঁড়ির খবর ঢেলে দিয়ে বসে আছেন। সবাই তার রসালো আলাপ আড়েচাড়ে শুনছে, আর ভাবছে এমন গর্দভও দুনিয়ায় পয়দা হয়!
মাছে-ভাতে বাঙালি। ‘ভেতো বাঙালি’ বলে এক রকম পরিচিতি কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। খাদ্য-খানায় বরাবরই আমাদের ব্যাপক আগ্রহ, যা কি না মোটামুটি বিশ^বিদিত। দাওয়াতে গেছেন, খাবার সার্ভ করা হচ্ছে। দু-একজন দেখবেন খাবার আসা মাত্র এমন হুড়াতাড়া (তাড়াহুড়ো নয়) জুড়ে দেয় যেন ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। আসলে এরা খানিক লোভী প্রকৃতির। পাছে দেরি করলে অন্যরা মাটনের ভালো পিসটা নিয়ে নেয়, মাছের কোলটা নিয়ে গাদার মাছ ফেলে রাখে, তাই যতটা সম্ভব মাছরাঙা স্টাইলে ছোঁ মেরে পছন্দের মাছ-মাংস নিয়ে নেয় নিজের প্লেটে। দেখে লজ্জা পাই, কিন্তু কিছু করার নেই। আত্মসম্মান বাঁচানোই দায় তখন।
আমরা এখনো লাইন মানতে শিখিনি। ক্লাস নাইন পড়–য়া বাচ্চারা সহপাঠি-পাঠিনীদের সঙ্গে আচ্ছ্বাসে লাইন মারতে পারলেও নাগরিক-বুড়ো বাচ্চারা লাইনে দাঁড়িয়েই অমনি গুঁতোগুঁতি শুরু করে দেয়Ñ সে হোক না গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের লাইন বা সিটিবাসের লাইন। গুঁতিয়ে ব্যাপক মজা পায় এরা। কবে যে আমরা একটু সভ্য হব!
মাঝে মাঝে মনে হয় সভ্যতা দূরে থাক, আমরা তো পশ^ধম জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সারমেয়র কথাই ধরুনÑ ওরা চার ঠ্যাঙের একখানা তুলে তিন ঠ্যাঙে অমনি যেখানে সেখানে জলবিয়োগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নগরের ফুটপাতে দুপেয়ে সারমেয়র সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এদের মূত্রের উৎকট দুর্গন্ধে ফুটপাতে পা রাখা দায়। মেয়র মহোদয়গণ প্রায়শ বলে থাকেন, প্রাণখুলে হাসুন, মনমেলে হাঁটুন। কিন্তু হাঁটব কোথায়Ñ মূত্রধোয়া ফুটপাতে!
ধূমপানে বিষপানÑ শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। পাবলিক প্লেসে ধুমপানের কড়া শাস্তি বিদ্যমান। কিন্তু তাতে ওই সকল বোকা বেবুঝ ধুমপায়ীদের যত্রতত্র বিড়িফোঁকা কি থেমেছে! এদের পাশে বসাও দায়। কেমন বিটকেল তামাকপোড়া গন্ধ বেরোয়। কিংবা ধরুন থুতুওয়ালা বা পানখোরÑ ইচ্ছে হলেই থুঃ করে একদলা রক্তিম থুতু ছিটিয়ে দিল আপনার গায়ে বা পায়ে। এরা এতটাই মাতোয়ারা, অকারণ থুতু বা পানের পিক ফেলা যে অন্যায় এটাই বোঝে না।
একটু নিচুতলার কথা বলি। আবার লোকাল বাস। সামান্য হেলপার, কিন্তু ওদের আচরণে আদিখ্যেতা বা অসভ্যতা স্পষ্টতই প্রকটিত। বিশেষ করে নারী যাত্রী ডেকে তোলার সময় বাঁ হাতখানা এমনভাবে যাত্রীর কোমর পেঁচিয়ে ধরে যেন আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম! এহেন আচরণ জাতি হিসেবে আমাদের নিচুত্বকে উদোম করে দেয়।
বিশেষ প্রয়োজনে এক দফতরে গেছি, সেখানে অশেষ বিরক্তি উপহার পেলাম। আমাকে বোধহয় তার পছন্দ হয়নি, তাই অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে ফোনের ওপারে কাকে যেন আচ্ছ্বাসে ধমকালেন। কারণটা হলো, উনি কত বড় হনু সেটা আমাকে বোঝাতে চান। অনেকটা ঝিকে মেরে বৌকে শেখানোর মতো। মানুষ যে কত রকমভাবে ইতরামি করতে পারে, রাস্তায় না বেরোলে বোঝা কঠিন।
আমরা আসলে নগরে থাকি বটে, কিন্তু আমাদের সেই নাগরিক সভ্যতাবোধ বা সিভিক সেন্স এখনো তৈরি হয়নি। ফলে প্রায়শ চলতিপথে নানা রকম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। পরিশেষে মহামতি সক্রেটিসের একটি কথাÑ নগরে নাগরিক থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত। অর্থাৎ যারা কি না এখনো নাগরিক বোধসম্পন্ন হয়ে ওঠেননি, তাদের জন্য তিলোত্তমা ঢাকা আপন নিবাস নয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান