নারী আত্মঘাতী : কেন তাদের এই বিপথগামীতা?
ডা. জাকির হোসেন
আদিম যুগে মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত না, কোনো আধুনিক অস্ত্র তৈরি করতে কিংবা সেই সকল অস্ত্রের ব্যবহারও জানত না। জীবন বাঁচাতে প্রতিনিয়ত, প্রতি পদে লড়াইসংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব মানুষকে বহুগুনে আধুনিক জীবনের গ-িতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে। সেই সঙ্গে তৃষার্ত বিজ্ঞানীর নিরলস শ্রম ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কারে দিনেদিনে মানুষ সভ্যতার চরম থেকে অতি চরম শিখরে পৌঁছার লড়াই করছে। সেই স্থিতিশীল যুগের সময় থেকে কত সামনে চলে এসেছি আমরা। বিজ্ঞান আমাদের যে বেগ উপহার দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে সমানভাবে আবেগটুকুও কেড়ে নিয়েছে। আবেগ হারিয়ে যাওয়ার ধাক্কার কুফল বহু আগেই সেই পশ্চিমা থেকে শুরু করে বাঙালি সমাজেও এসে পড়েছে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে আজ আমরা সবচেয়ে বেশি অসভ্য হয়ে পড়ছি। সমাজের সবচেয়ে জঘণ্য ও বর্বর কাজ সংঘটিত হচ্ছে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক কিংবা পরিবারের সন্তান থেকে শুরু করে পিতা-মাতা দ্বারা। সমাজে প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর দ্বন্দ্বের গ-িকে পেছনে ফেলে আজ পরিবারের রক্তের সম্পর্কের ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, ভাইয়ে-বোনে দ্বন্দ্ব এমনকি সন্তান ও পিতা-মাতার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করছে।
পরিবার আর সমাজের গ-ি ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের সর্বত্র বিরাজ করছে হিংসা, ঘৃণা আর ক্রোধ। এই ক্রোধের শেষ ঢেউটি আজ আছড়ে পড়েছে আজ বাঙালি মায়েদের সন্তানদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জায়গাটিতে। বাঙালি মায়েরা নিজেরা না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে পারলেই বেশি আত্মতৃপ্তিতে থাকতেন। জীবনের সামগ্রিক বিপদকে বুকে জড়িয়ে সন্তানকে বিপদের হাত রক্ষা করে শত সহস্র পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে বাঙালি মায়েরা। কিন্তু ক্রোধের কোনো দুষ্ট অভিশাপ আজ বাঙালি মায়েদের ভালোবাসাকে অঙ্কুরেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আজ কথায় কথায় মা নিজেই সন্তানের খুনি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। কখনো সন্তানের মুখে বিষ তুলে দিয়ে, কখনো গলা টিপে আপন সন্তানকে হত্যা করছে। আবার কখনো গাড়ির চাকার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিংবা সন্তানের গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট পরিয়ে দিয়ে সন্তানসহ আত্মঘাতী হচ্ছে নয়মাসের গর্ভধারিণী মা।
কেন এই ক্ষোভ, কেন বাঙালি মায়েদের হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা শব্দটি হারিয়ে যাচ্ছে? কোন দুষ্ট গ্রহের এই ঘৃণা, হিংসা, লোভ কিংবা মোহের তাড়নায় মায়েরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে? ভেবে দেখার সময় এখন নয় বরং বলব ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। নিরক্ষতাদূরীকরণ একসময় আমাদের সেøাগান ছিল। সেই সেøাগান এখন আর নেই। এখন শতকরা শিক্ষার হার ৭০ ভাগ। তবেই কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হলো জাতি? কেন প্রতিনিয়ত আমাদের মাযেরা পরিবার, সমাজ কিংবা জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে? প্রতিটি প্রশ্ন নিয়ে একটু রাষ্ট্রীয়ভাবে ভেবে দেখার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখনই এই অধঃপতন ঠেকোতে না পারলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় মাশুল গুনতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমা