‘সঙ্গী বললেও জঙ্গি শুনি’
মাহফুজ জুয়েল
বিছানা গোছাতে গোছাতে শব্দমিস্ত্রীর স্ত্রী বলল, ‘আজকাল কেউ সঙ্গী বললেও জঙ্গি শুনি!’ স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে মিস্ত্রী বলল, ‘তাও ভালো। আমি তো লুঙ্গি বললেও জঙ্গি শুনি। এমনকি জাঙ্গিয়া দেখলেও জঙ্গির কথা মনে পড়ে!’ তারপর খাট-কাঁপানো খট্টহাসি। নেপথ্যে হাছন রাজার গানের প্যারোডিÑ ‘জঙ্গি কে বানাইলো রে
বাঙালিরে জঙ্গি
কে বানাইলো রে।।
বানাইলো বানাইলো জঙ্গি
তার নাম রাজনীতি মাওলা।
দেখিয়া তার রূপের ঝলক
হাসন রাজা হইলো আউলা’।।
হ্যাঁ, পাঠক, রাজনীতির রূপের ঝলক দেখলে আউলা না হয়ে উপায় নেই। এখন জঙ্গি শুনলেই আমাদের মনের ভঙ্গি পাল্টে যায়। স্বতঃস্ফূর্ত ঘৃণা জাগে। মনেই হয় না, এই জঙ্গিরাও কারও না কারও সন্তান। মনেই হয় না, ওরা এই বাংলাদেশের এই বাঙালিরই ছেলে-মেয়ে। আমাদেরই ভাই-বোন। বরং মনে হয়, অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। মনে হয়, সব জঙ্গিকে মেরে ফেলা উচিত। এমনকি জঙ্গিদের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কারও কারও ক্রিকেটে শত্রুপক্ষের উইকেট পতনের মতোন আনন্দ হয়। কেউ কেউ মনে মনে বিজয়োল্লাস করে, খুশি হয়, স্বস্তি পায়। শান্তি লাগে। ভরসা জাগে। এমনকি খোদ জঙ্গিদের পরিবারগুলোও তাদের মৃতদেহ গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না। মানে দাঁড়াল, স্বয়ং স্বজন-পরিজনরাও জঙ্গিদের ঘৃণা করছে এবং এটাই স্বাভাবিক।
আসুন, এবার আমরা জঙ্গি শব্দটার গোষ্ঠী উদ্ধার করি। জঙ্গ মূলত একটি ফার্সি শব্দ। উর্দুতেও এর প্রচুর ব্যবহার আছে। উর্দু আর ফার্সিতে শব্দটা লড়াই বা যুদ্ধ অর্থে ব্যবহার হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ আর জঙ্গি মানে যোদ্ধা, লড়াকু। যেমন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’কে উর্দু-ফার্সিতে ‘জঙ্গে আজাদি’ বলা হয়, আর স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের বাংলায় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে আর উর্দু-ফার্সিতে বলে ‘জঙ্গিয়ে আজাদি।’ ফার্সি আর উর্দুতে জঙ্গি একটি সম্মানিত শব্দ। কিন্তু বাংলায় জঙ্গি শব্দটি ঘৃণাবাচক; ধর্মান্ধ নৃশংস খুনি বা সহিংসতাপ্রবণ মানুষকে বোঝায়।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আমার আপনার ভাই-বোনকে ধর্মান্ধ নৃশংস খুনি বা সহিংসতাপ্রবণ মানুষ বা জঙ্গি বানাল কারা? হ্যাঁ, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা! আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল এবং আছে যারা। সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে ছিল তাদের উন্নয়ন-দোসর বিদেশি প্রভুরা।
হ্যাঁ, বাঙালির সন্তানকে কেউ ‘মানুষ’ করতে চায়নি। সবাই মিলে, ৪৫ বছর ধরে একটা কাজই ‘মিলেমিশে’ করেছে, খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে, তা হচ্ছে, জঙ্গি উৎপাদন। সেই সুমহান কর্মযজ্ঞ এখনো থামেনি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান