আইপিইউ সম্মেলন এবং কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং
অরুণ কুমার বিশ^াস
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সম্মেলন। এই সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য ‘জবফৎবংংরহম রহবয়ঁধষরঃরবং: উবষরাবৎরহম ড়হ ফরমহরঃু ধহফ বিষষ-নবরহম ভড়ৎ ধষষ’। প্রারম্ভিক সভায় উপস্থিত হয়ে প্রতিটি দেশ ও মানবতার সমতার কথা তুলে ধরে নানা রকম বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্লাঘার কথা হলোÑ আইপিইউ-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের মাননীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। শুরু থেকেই এই সম্মেলনে বাংলাদেশ তার বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পেরেছে।
এতে যে কেবল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে তা-ই নয়, বরং বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বৈদেশিক বিনিয়োগের যে অপার সম্ভাবনা ও বিস্তর সুযোগ বিদ্যমান, সেটিও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হচ্ছে। মাননীয় স্পিকারের পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিগণও এই সম্মেলনে উপস্থিত নানা দেশের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু অগ্রসরমানতার বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছেন। ‘সাইড-লাইন টক’ হিসেবে এসব আলোচনায় স্বভাবতই বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। মার্কেটিং-এর ভাষায় ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। ব্র্যান্ডিং শুধু যে পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে করা হয় তা নয়, বরং যেকোনো দেশও চাইলে তার পজিটিভ ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এই সম্মেলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য যেমন রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক গুরুত্বও কিছু কম নয়। আইপিইউ সম্মেলনস্থলের পাশেই রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে ছিল একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। সেখানে অন্তত ৫৯ রকম পণ্য যা কি না বিদেশে রপ্তানিযোগ্য, তা অত্যন্ত সৌকর্যপূর্ণভাবে প্রদর্শন করা হয়। ফলে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের বিষয়ে সম্যক অবহিত হবার সুযোগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়নের সাম্প্রতিক উৎকর্ষ ও এই সম্মেলনে তার চমৎকার শো-কেসিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সম্মেলনের প্রথম দিন নারী ফোরামের আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন মাননীয় এমপি দিপু মনি। সেখানে বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে রাষ্ট্রের সামষ্টিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীর যে অসামান্য অবদান, তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব উন্নতির কথা শুনে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন। অভিজ্ঞ কূটনীতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, আইপিইউ সম্মেলনে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলোÑ দেশ হিসেবে বিশ্ববলয়ে তার ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরা। পজিটিভ কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং-এর এমন সুবর্ণ সুযোগ আগে আর কখনো হয়নি।
সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের দৃঢ় মনোভাবের বিষয়টি এই সম্মেলনে প্রাধান্য পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া টেরোরিস্ট অ্যাটাক ও তার বিরুদ্ধে পরিচালিত সফল অভিযানের বিষয়টিও বাংলাদেশের ইতিবাচক অবস্থানের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ হিসেবে উঠে আসে। আইপিইউ মহাসচিব দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা মার্টিন জুঙগং এই সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থাপিত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা কার্যক্রমের ফিরিস্তি সম্পর্কে জেনে ভূয়সী প্রশংসাজ্ঞাপন ও সন্তোষ প্রকাশ করেন।
শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই নয়, উন্নত বিশ্ব বলে পরিচিত ইউরোপীয়ান ব্লকের অনেক সদস্য, যারা কি না নিজেদেরকে কেষ্টবিষ্টু ভাবেন, তারাও দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এখন আর নেহাতই উন্নাসিকতার চোখে দেখছেন না। বরং আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থান ও নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্যে তাদের চোখেমুখে একরকম বিস্ময়-বিপন্ন আলোকচ্ছটা লক্ষ্য করা যায়। এ সবই সম্ভব হয়েছে মূলত আইপিউই সম্মেলন আয়োজনে আমাদের বলিষ্ঠ কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি নিজেদের অর্জনগুলোকে বিশ্বনেতৃবৃন্দের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। ওরা জেনে গেছে, বাংলাদেশ এখন আর একটি মধ্যম আয়ের দেশ শুধু নয়, বাংলাদেশের স্বপ্ন অঙ্কিত হয়েছে বিশাল ক্যানভাসজুড়ে। দারিদ্র্যবিমোচন ও নিরক্ষরতা থেকে মুক্তির পাশাপাশি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আর্থ-রাজনীতিতে নিজের অবস্থান দৃঢ়করণ ও সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমশ বিশ্বমানচিত্রে একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে জায়গা করে নেবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান