ফেসবুক জিন্দাবাদ!
অজয় দাশগুপ্ত
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
ফেসবুক রাত বারোটার পর বন্ধ হবে কি হবে না এ নিয়ে দিনের আলোয় বেশ হৈ চৈ দেখলাম কদিন। ভালোই বটে। যারা ফেসবুক বন্ধের আগেই এ নিয়ে কথাবার্তা বলছেন, আগ বাড়িয়ে রাস্তায় নামার ও হুমকি দিচ্ছেন তাদের সন্দেহ নিরসনের জন্য তারানা হালিমকে মুখ খুলতে হলো। সামাজিক মাধ্যমে এই ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি এমনকি যারা দেশের ভেতরে তাদের জন্য ও এ এক অসাধারণ যোগাযোগমাধ্যম। স্কুল, কলেজ বা উচ্চতর বিদ্যাপিঠে পড়ার পর হারিয়ে যাওয়া কতজনকে খুঁজে পেয়েছি এর বদৌলতে। আজ দেশে-বিদেশে সত্যি কোনো তেমন দূরত্ব নেই। যোগাযোগের এই মাধ্যমকে মানুষ আরও অনেক কাজে ব্যবহার করছে। ভালো এবং মন্দ যেহেতু হাত ধরাধরি করে চলে এর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? ফেসবুক একদিকে যেমন আশা ও সৃজনের হাতিয়ার আরেকদিকে হয়ে উঠছে ভয়ের। ভয়টা কোথায় সবাই জানে। কিন্তু যার যার সুবিধা আর ভোগের কারণে মানতে চায় না।
এই মাধ্যমটি চালু হবার পর মানুষের মন ও চিন্তা আসলে কোথায়, কেন, কিভাবে ঘুরপাক খায় তা সবচেয়ে বেশি জানে নারী। নারীদের কাছে ইনবক্সগুলো এক একজন মানুষের চরিত্র সনদ। দেশের কত বাঘা বাঘা মানুষ যাদের টকশো বা টিভিতে দেখে মানুষ ভয় পায় কিংবা এমন সব সেলিব্রেটি বা কেউকেটা জন যাদের ভয়ে সমাজ সিঁদিয়ে থাকে তাদের ভাবভঙ্গি আর আকুতিতে নারীরা রীতিমতো লজ্জিত আর হতবাক। আমাকে এমন অনেকে বলেছেন, যারা মেয়েদের নামে একাউন্ট খুলে এর স্বাদ পেয়েছেন। আমি কাউকে দোষারোপ করার জন্য লিখছি না। এটি একটি প্রবণতা মাত্র। কেউ ধরা না দিলে এইসব বায়বীয় মাধ্যমে কাউকে কেউ কিছু করতে পারে না। কিন্তু এটা মানতে হবে মুখ ও মুখোশের ব্যবধান ঘুঁচিয়ে দিয়েছে ফেসবুক। এর বাইরে যারা তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরী তাদের কাছে এটি নিছক ছেলেখেলার বিষয়। আমার পরিচিত এক হেডমিসট্রেস অভিযোগ করেছিলেন, বয়সে ছেলের চেয়ে ও ছোট বালকেরা তার কাছে এমন সব কথা লেখে যাতে তার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। এই যে অবাধ লেখার স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সেটা কি ব্লক বা আনফ্রেন্ড করলেই চুকে যায়? একবার যার আসল চেহারা বা বিকৃতি বেরিয়ে আসে তাকে কি আর বিশ্বাস করা চলে? না সে চাইলেও নিজেকে পাল্টাতে পারে? স্বনামধন্য এক কবি যিনি পুরস্কারের জন্য দেন দরবার থেকে হাতে পায়ে ধরতে দ্বিধা করেন না তিনি নারীবন্ধু পেলেই লেখেন, আমারে করো তবো বীণা। এর মানে সবাই বুঝি। এককথা সাহিত্যিকের জ্বালায় ফেসবুক ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে অনেক মেয়ে। শুধু এরা? সমাজের সব পেশা সব বয়সের মানুষের ধারণা ইনবক্স মানে এসব করে বেড়ানোর জায়গা। এরপর আছে রাত জাগার ব্যাপার। একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এক কবিকে জানি আপনি যখনই অন করবেন দেখবেন তার সবুজ বাতি জ্বলছে। এ যেন অন্তহীন ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হয়ই না। এই রাতজাগা এক ধরনের রোগ। তার মতো বয়ষ্কজন এই ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারছেন না আর তারুণ্য তো কোনো ছাড়। যাদের বয়স কম তারা সারারাত জেগে ফেসবুকে সময় কাটায়। এমন কি কি কথা এমন কি আড্ডা বা বিষয় থাকতে পারে যা সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায় করা যায় না বা বলা যায় না? এই প্রজন্ম যদি এভাবে বুঁদ হয়ে ফেসবুকে রাত কাটায় তা কি আসলেই শরীরের জন্য বা মনের জন্য ভালো হতে পারে?
কয়েকমাস আগে আমি ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। তাদের বড় বড় দুই শহরের একটি হো চিমিন সিটি আরেকটি হ্যানয়। হো চিমিন সিটিতে সবকিছু এখনো আমেরিকান স্টাইলের। সেখানে সরকার মধ্যরাত অবধি সুযোগ দিলেও হ্যানয়ে রাত দশটার পর ইন্টারনেট স্পিড কমতে থাকে। পর্যটক রাতের অফিস কিংবা দরকারি জায়গাগুলো ছাড়া ঘরবাড়িতে ইন্টারনেট গতি কমানোর কারণ হিসেবে তারা বলে আমরা চাই সুস্থ ও স্বাভাবিক তারুণ্য। যারা সকাল এগারোটা অবধি ঘুমাবে না। যারা স্কুল-কলেজে এসে ঢুলুঢুলু চোখে অমনোযোগী হবে না। যারা চীনে যায় তারা জানে সেখানে এইসব মাধ্যমে ঢোকা বা ব্যবহার করায় কতটা কড়াকড়ি। আমার পুত্রসম এক তরুণ কিউবা গিয়েই জানিয়েছিল আমি যেন কোনো উদ্বেগে বা টেনশনে না থাকি। কারণ ইন্টারনেট স্পিড এমন যে ঢোকার চেয়ে না ঢোকাই ভালো। ফলে সে কদিন যোগাযোগ করতে পারবে না। আরও অনেক দেশে এমন ব্যবস্থা আছে।আমাদের সমাজে ডাবল বিপদ। একদিকে কেউই এর নিরাপদ ও সঠিক ব্যবহার জানে না, আরেকদিকে রাত জেগে ইচ্ছেমতো এর এস্তেমাল করার ঝুঁকি। এতে তারুণ্য হয়ে উঠেছে সুচিন্তাহীন বিকারগ্রস্ত এক ধরনের পোকা প্রজাতি। মা-বাবার চোখের ঘুম হারাম করা এদের দেখে মনে হয় না আগামীতে দেশের নেতৃত্ব বা ভালো কাজের জন্য মানুষজন খুঁজে পাওয়া সহজ কিছু হবে। এমন দেশে এমন সমাজে যত দোষ নন্দ ঘোষের ওপর চাপিয়ে আমরা আধুনিকতার ভান করতে পারি বটে আসলে মুক্তবুদ্ধি খোলার বা চর্চার কোনো সুযোগ নেই এতে।
তারপরও সরকারকে ধন্যবাদ। তারা মধ্যরাত থেকে সকাল অবধি এটি বন্ধ রেখে ঝামেলা তৈরি করেননি। আমরা ভুলে যাচ্ছি একসময় রেডিও টিভি সবকিছুই রাত বারোটায় জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে বন্ধ হয়ে যেত। তখনকার মানুষের সঙ্গে এখনকার মানুষের তফাৎ এই, তখন আমরা জঙ্গির নাম শুনিনি। বোমা, গ্রেনেড বা আত্মঘাতীকে চিনিনি। তখন আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি মায়া-মমতার ভেতর বসবাস করতেন। সামাজিক মিডিয়া বা সব জানালা খুলে এখন আর খোঁপায় ফুল দেওয়া কেশের দেখা মেলে না। মেলে না সেই তরুণ যারা দেশ বা জাতির জন্য আত্মদানে আগ্রহী। তার বদলে আজ কেবল হানাহানি আর নিজেকে উড়িয়ে অপরকে মারার এক উদগ্র প্রবণতা চারদিকে।
তবু আমরা সারাদিন সারারাত ফেসবুক চাই। যাতে এঘর থেকে ওঘরে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলতে পারি, এককাপ চা দেবে? আমি একটু চ্যাটে আছি। ঘরের রোগীকে হাসপাতলে পাঠানোর আগে ছবি তুলে পোস্ট দিয়ে বলি, দোয়া চাই। কারও সঙ্গে পরিচিত হবার আগেই সেলফি তুলে জানিয়ে দিই এই যে আমরা। লাইক আনলাইকের এই জমানায় ফেসবুক জিন্দাবাদ ছাড়া আর কি বলার আছে আমাদের?
সম্পাদনা: আশিক রহমান