ঐতিহ্যের ধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের ‘আল আজহার’
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
৯৭০ খ্রিস্টাব্দ তখন। ফাতেমিবংশের দাবিদার ইসমাইলিরা দখল করে মিশর। তাদের খলিফা ও ইসমাইলি ইমাম আল মুইজ ফাতেমি নেতা জওহারকে ডেকে পাঠান। রাজধানী কায়রোতে নির্মাণ করান একটি জামে মসজিদ। রাসুল (সা.)-এর আদরের দুলালী হজরত ফাতেমাতুজ্জাহরা (রা.) এর নামে মসজিদটির নাম ‘আল আজহার’ রাখেন। এর কিছুদিন পরের গল্প। মসজিদটি ইসমাইলি শিয়া ফাতেমিদের আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার ও শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৯৭২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবিক ৩৫৯ হিজরির জমাদিউল উলা মাসে কায়রো শহরেই প্রতিষ্ঠিত হয় এরই সঙ্গে লাগোয়া একটি গবেষণাকেন্দ্র। আল আজিজ বিল্লাহ ও আল হাকিম আল আমর মসজিদের প্রাঙ্গণেই প্রতিষ্ঠা করেন সেটি। ফাতেমি খলিফারা সেখানেই তাদের গবেষণাস্থল হিসেবে জড়ো হতে থাকেন। ধীরে ধীরে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে আল আজহার গবেষণাকেন্দ্রটি। পরবর্তীতে এটিই অনন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। মুসলিমবিশ্বের নানাদিক থেকে সেখানে তখন ঢল নামে শিক্ষানুরাগীদের। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির হামলার মধ্য দিয়ে মিশরে ফাতেমি শাসনের পতন হয়। তখন আল আজহার শিক্ষাকেন্দ্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। কেবল সুন্নি মাজহাবের পড়াশুনোই গুরুত্ব পেতে থাকে। এদিকে মুসলিমবিশ্বের পূর্বাঞ্চলে মোঙ্গলদের হামলা হয়। সঙ্গে স্পেনে মুসলিম শক্তি হ্রাস পায়। তাই সেসব এলাকার শিক্ষানুরাগীরা আল আজহারে আসতে থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আগের প্রাণ ফিরে পায়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুহাম্মদ আবদুহ মিশরের প্রধান মুফতির দায়িত্ব লাভ করেন। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে যোগ করেন নতুন নতুন বিষয়। বিস্তৃত হয় এর শিক্ষা ও গবেষণার পরিধি। গত পঞ্চাশ বছরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। মিশরের বিভিন্ন শহরে খোলা হয়েছে এর কয়েকটি শাখা। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েদের জন্যও আলাদা শাখা চালু করা হয়েছে। আল আজহারে বর্তমানে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। তাদের অধিকাংশই ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশুনো করলেও দর্শন, অর্থনীতি, চিকিৎসা, কম্পিউটার, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, চাঁদের পর্যায়ক্রম নিরূপণ বিভাগেও অনেকেই অধ্যয়ন করছে। পাঠ্যক্রমের ভেতর ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়সহ একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মুসলিমবিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহার। আরবি সাহিত্য ও ইসলামিক স্টাডিজে বিশ্বের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে আজ এর খ্যাতি চারদিকে। মিশরের প্রাচীনতম ডিগ্রি গ্রান্টিং বিশ্ববিদ্যালয়ও এটি। ১৯৬১ খৃস্টাব্দে অতিরিক্ত অধর্মীয় বিষয় পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়। ৪৫টি ভবনের প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশি ছাত্রাবাসও রয়েছে। ১০৫টি দেশের পাঁচহাজার ছাত্রের দিব্যি বসবাস তাতে। রয়েছে প্রত্যেক ছাত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ও তিনজন মিলে একসঙ্গে থাকার কক্ষেরও সুব্যবস্থা। ছেলেদের ছাত্রাবাসকে মদিনায়ে কোবরা বা বড় শহর বলা হয়। যা সার্বক্ষণিক কঠোর নিরাপত্তাসম্পন্ন পরিপূর্ণ একটি শহর। যেখানে দোকানপাট, ব্যাংক, হাসপাতালসহ অফিস রয়েছে। আর মেয়েদের শহরটিকে বলা হয় মদিনায়ে সুগরা বা ছোট শহর। সেখানেও হুবহু সুবিধে বিদ্যমান। ৫৫টি দেশের ৫০০জন মেয়ে নিয়মিত আবাসিক থেকে পড়াশুনো করে আল আজহারে। শহর দুটো পরিচালনার জন্য আবার একজন দায়িত্বশীলও রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয় বৃহৎ পরিসরের আল আজহার ইনস্টিটিউশনের তত্ত্বাবধানে। মিশরের গ্রান্ড মুফতি হয়ে থাকেন বৃহৎ এই ইনস্টিটিউশনের প্রধান। ইনস্টিটিউশনটির তিনটে বিভাগের একটি এই বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামি গবেষণা, ফতোয়া জারি, সমকালীন বিষয়ে সাময়িকী প্রকাশ ও ইসলামপ্রচারের কাজ আরেকটি বিভাগের। তৃতীয় আরেকটি বিভাগ রয়েছে, যা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এই দপ্তরের অধীনে নানাধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুল-কলেজগুলোতে এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আল আজহার ইনস্টিটিউশনের পরিধি বৃদ্ধি পেলেও প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও নানা সমস্যার সম্মুখীন। কোনো কোনো ইস্যুতে বেশ বিতর্কিতও বটে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিজস্ব পরিচিতি, স্বকীয়তা ও প্রভাব কিছুটা হলেও হারাতে বসেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গ্রান্ড মুফতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়টি মিশর সরকারের হাতে থাকায় আল আজহার সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মিশর সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা ও মিশর সরকারের নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পথচলায় স্থানীয় জনগণের মাঝে আল আজহারের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে দিনদিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর হাদিস বিভাগ, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত