একজন যোদ্ধার জন্য ভালোবাসা
মঞ্জুরুল ইসলাম পান্না
তবু লিখছি। লিখছি প্রগাঢ় ভালোবাসায় একজন জীবন্ত কিংবদন্তির কথা-কালোজয়ী একজন অধিনায়কের কথা-সময় আর শিল্পের একজন অক্লান্ত যোদ্ধার কথা-দূরন্ত এক স্বপ্নবাজের কথা। লিখতে চাই, পরিণত সময়ের আগেই ইতিহাস হয়ে ওঠা একজন দেশপ্রেমিকের কথা-একজন মান্যবর প্রিয় মাশরাফির কথা। সত্যি কথা বলতে খেলা আমি খুব কম বুঝি। তাই বিষয়টি নিয়ে লেখা আমাকে মানায় না বলেই লেখার শুরুতে ‘তবু’ শব্দটার ব্যবহার। কিন্তু মাশরাফি বিন মুর্তজা নামের মুকুটহীন এক স¤্রাটকে নিয়ে ভালোবাসা জানানোর অধিকার তো রয়েছে সবার।
বিদেশের মাটিতে বসে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফির অবসর নেওয়ার আচমকা ঘোষণায় হতবাক পুরো বাংলাদেশ। ধাক্কা খেলো অগণিত হৃদয়, আবেগে ভাসল কোটি কোটি চোখ। মিছিল হলোÑ স্লোগান হলো, মানববন্ধন হলো প্রিয় ক্যাপ্টেইনের সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য। ২০১১ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জাতীয় দলের বাইরে রাখা হয়েছিল অসংখ্য মানুষের আইকন এই মানুষটিকে। মাশরাফির চোখের নিরব জল তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে এদেশের মাটিকে জানিয়েছিল, তিনি খেলতে চান। কিন্তু বিসিবির হর্তাকর্তাদের মন গলেনি। ভেঙেছিল মাশরাফি ভক্ত কোটি মানুষের হৃদয়। সেবারও মানুষ রাজপথে নেমেছিল দিনের পর দিন। দাবি জানিয়েছিল বিশ্বকাপে তাকে খেলানোর জন্য। পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো খেলোয়াড়ের জন্য সাধারণ মানুষের এমন আবেগ আর দুর্দান্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
১৪ বছরের ক্যারিয়ারে চোটের কারণে ১১ বার দলের বাইরে থাকতে হয়েছে মাশরাফিকে। শরীরে ১১টি অপারেশনের জমাট যন্ত্রণা নিয়েও দমে যাননি তিনি। দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতির কারণে প্রচ- মানসিক শক্তিতে আহত পায়ে বারবার ছুটে গেছেন যুদ্ধের ময়দানে। এক পায়েই ভর করে পুরো বাংলাদেশকে টেনে তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়। ক্রিকেট অনেকখানিই ¯œায়ু নির্ভর খেলা। নেতৃত্বের অসাধারণ দক্ষতায় পুরো দলকে ভাসিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের গভীর সমুদ্রে, চোখে বুনে গেছেন দারুণ সব স্বপ্ন জয়ের ছবি। ছিনিয়ে এনেছেনও সেসব জয়ের অনেকগুলো।
তার ব্যক্তিত্ব পাহাড়সম উচ্চতার। টি-টোয়েন্টি থেকে তার আকস্মিক অবসরের ঘোষণার পেছনে অনেক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিসিবির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এখন হেড কোচ হাতুরুসিংহে না-কি হয়ে উঠেছেন এদেশের ক্রিকেটের সর্বেসর্বা। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বোর্ড চায় তিন ফর্মে তিন অধিনায়ক। টি-টোয়েন্টি থেকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে হবে, এ কথা জানার পর অভিমানে সেখান থেকে একেবারে অবসরেরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন সবার প্রিয় ম্যাশ। অবসরের সিদ্ধান্তের পেছনে বোর্ডের কোনো চাপ ছিল কি না, সাংবাদিকদের এমন কৌতুহলী প্রশ্নে ইতিহাস নির্মাণকারী অধিনায়ক সোজা জানিয়েছেন, ‘আমার কাছে মনে হয় এই সময়ে বিতর্ক তৈরি না করে আমাদের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করা উচিত। আমাদের ক্রিকেট এগিয়ে যাক। আমার কাছে মনে হয় না এই সব নিয়ে আলোচনা করার কিছু আছে।’ এটা তার নিরেট ব্যক্তিত্বের পরিচয়। বিতর্কের ডালপালা ছড়ানোর সুযোগ দিতে চান না তিনি, চান কেবল নিজ দেশের ক্রিকেটের উন্নতি। নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসর নেওয়ার জন্য এটাই আমার উপযুক্ত সময়, যাতে অনেক তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটার তাদের প্রতিভা তুলে ধরতে পারে।’ আর সব বাদ দিয়ে শুধু এই কথাটিও যদি সত্যি হয়ে থাকে সেখানেও ফুটে ওঠে একজন দলনেতার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব।
রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিভিন্ন ক্লাব এমনকি ক্রীড়া সংগঠনগুলোতেও একবার নেতা বা অধিনায়কের স্থানে বসলে তা আর নিজ থেকে ছাড়ার নাম নেন না কেউ। এখানেও মাশরাফি ব্যতিক্রম। দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত এই মানুষটি হয়তো এও ভেবেছেন, মানুষের তুমুল ভালোবাসা উষ্ণ থাকতে থাকতেই একে একে জায়গাগুলো ছড়ে দেওয়া উচিত প্রত্যেকের, উজ্জ্বলতর স্মৃতিতে নিজেকে আরও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
উচিত অনুচিত বুঝি না। ফর্মে যতদিন থাকতে পারবেন বলে মনে হয় মাশরাফিকে দায়িত্ব নিয়ে খেলার সুযোগ দিতে হবে আরও অনেক দিন। সব জায়গাতেই আমরা নোংরা রাজনীতি দেখতে চাই না। এখন থেকেই আশঙ্কার কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে জীবন্ত শৈল্পিক এই যোদ্ধাকে হয়তো খুব বেশি দিন আর রাখা হবে না ক্রিকেট যুদ্ধের ময়দানে। অথচ তার স্বপ্ন ২০১৯-এর বিশ্বকাপটা খেলে ক্যারিয়ারের ইতি টানা।
শেষ করব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ম্যাশভক্ত এক অজানা বন্ধুর কমেন্ট দিয়ে। ‘আমি আমার সন্তানদের গর্ব করে বলব, আমি মাশরাফি যুগের। আমি হিরো দেখেছি। আমি মাশরাফিকে দেখেছি। আমি একটি দুর্বল দলকে শুধু একটি পা নিয়ে সবল এবং জয়ী ক্রিকেট দল বানানো কালজয়ী দলনেতাকে দেখেছি। আমি গর্বিত মাশরাফি, আমি আপনাকে দেখেছি!’
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান