আইপিইউ সম্মেলন কী আদৌ প্রহসন, নাকি অর্জন?
দীপক চৌধুরী
এদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জঙ্গি। বিশেষ করে গত বছর পহেলা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় জাপানি, ইতালি, ভারতীয়, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হত্যার পর অতি দ্রুত বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় উঠে আসে। প্রকাশ না করলেও বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রও ক্ষুব্ধ হয় মনে মনে। অন্তরে যন্ত্রণা, কষ্টের হাসি ছিল প্রাণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ দক্ষতা ও জঙ্গি দমনে তার সরকারের সুকৌশল বিশ্ববাসীকে খানিকটা আশ্বস্থ করে। এমন ‘ধকল’ কাটিয়ে উঠতে সরকারকে অনেকে কাঠ-খর পোহাতে হয়। এবার আইপিইউ (ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন) সম্মেলন নতুন করে বিশ্বদরবারে আমাদের উপস্থিত করল, ‘আমরা পারি, আমরা বিজয়ী জাতি।’ আমাদের ইতিহাস রক্তে মাখা ইতিহাস। যে অনুষ্ঠানে বিশ্বের ১৩২টি দেশের ১ হাজার ৩৪৮জন আইপিইউ সদস্য অংশগ্রহণ করেছেনÑ তা কী ছোট অর্জন এ দেশের? মোটেই তা নয়Ñ অনেক বড় অর্জন? সদস্য দেশের নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন দেশের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রভাবশালী পার্লমেন্টারিয়ান, ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধান। কিন্তু এ সম্মেলন নিয়েও একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা হাস্যকর কথা বলেছেন, এটা নাকি প্রহসন!
৩ এপ্রিল এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলটি বলল, তারা মনে করে যে দেশে মানুষের মানবাধিকার লুণ্ঠিত, যে দেশের পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, সে দেশে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর সম্মেলন প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং নাগরিকদের মানবাধিকার লুণ্ঠিত, হত্যা, গুম, গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জনগণ জর্জরিত সেই দেশে আইপিইউর সম্মেলন একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।
প্রশ্ন করি, প্রহসন হলো কী করে? বৈষম্যের কথা বলা হয়নি এখানে? প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হযনি? বিএনপি কেন রাজনীতি করে? প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য নয়? সাধারণ মানুষের জন্য নয়? তবে কী শেখ হাসিনার সেই কথাই শতভাগ সত্য, বিএনপি রাজনীতি নয়Ñ ক্ষমতায় এসে ব্যবসা করে? ব্যবসার রাজনীতি। মানুষের জন্য নয়। কথায় আছে, কীসের মধ্যে কীÑ পান্তা ভাতে ‘ঘি’। এই ‘ঘি’র মতো উক্তি দীর্ঘ আট বছর ধরেই করে আসছে দলটি। হেফাজত ইসলামকে দিয়ে কি না করল ২০১২ সালে? হত্যা, সহিংসতা, ত্রাস! মতিঝিলে ধ্বংসাত্বক খেলা খেলেছিল। রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশাকে ‘ধর্ষণ’ করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিল না বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু তারা প্রতিহত করতে পারল না। দুইশ মানুষ হত্যা করল, পুড়িয়ে হত্যা। সরকারি কর্মকর্তা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হত্যা করল। পশু, বৃক্ষ, সড়ক-জনপথ তছনছ করল। কিন্তু নির্বাচন হতেই হলো এদেশে। বিএনপির আপত্তির জন্য কী এদেশে নির্বাচন হবে না?
এদেশের মানুষ তো মনে করি, সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা আর্জন করেছে। মনে রাখা দরকার, জঙ্গি হামলার ভয়কে উপেক্ষা করে বিশ্বের নেতারা এ সম্মেলনে জড়ো হয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করেছেন। হয়তো বুঝতে সক্ষম হয়েছেনÑ বাঙালি পারে না বলে কোনোকিছু নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় না ঘটলে কখনো আমরা এ সম্মেলনের ভাগিদার হতাম না।
আমাদের খ্যাতিমান অনেক গুণীজন বলে থাকেন, প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নেই, আর এই প্রতিশ্রুতি না থাকলে উন্নতি সম্ভব নয়। মজার ঘটনা হলো, এত বড় আইপিইউ সম্মেলন হয়ে গেল এ মাটিতে কিন্তু এ বিষয়ে ‘টু’ শব্দটি তারা করেননি। এ প্রান্তিকতা অবসানে রাষ্ট্রীয় নীতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সতর্ক, জাগ্রত। প্রান্তিক মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে সরকার কী চুপ? এ সরকারের কী কোনো পরিকল্পনা নেই? আগামী বাজেটে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ ৪৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হবে ৫২ হাজার কোটি হচ্ছে। আইপিইউ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে সারা বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল, তা ভেঙে গেছে। এ দেশ সম্পর্কে, এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো অপপ্রচার কাজে লাগেনি, শত্রুর মুখে ছাই দিয়েছে আইপিইউ সদস্যদের চোখ। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের রোল মডেল তা তারা দেখে গেছেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে ঢাকা ঘোষণা সম্পর্কে আইপিইউর চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, এবারের সম্মেলনে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, বৈষম্য কমাতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা, প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, সংসদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল করা, সবার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা, সামাজিক সংলাপ ও মানবসম্পদ বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সদস্য দেশগুলো নিজ নিজ দেশে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে কাজ করে যাবে।
অত্যন্ত সাহসী উচ্চারণ করে সাবের হোসেন চৌধুরী আরও বলেছেন, সেন্ট পিটার্সবার্গে হামলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেখানে আইপিইউর পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। জঙ্গিদের ভয়ে আমরা থেমে থাকব না। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) সভাপতি শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন বলেই এত বড় একটি অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ দিনব্যাপী আইপিইউ সম্মেলনে আলোচনা হয়েছেÑ নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান