ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
মিল্টন বিশ্বাস
৬ এপ্রিল (২০১৭) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন থেকে জঙ্গিবাদীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আওয়াজ উঠেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই মহাসম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন তার জঙ্গিবিরোধী অবস্থানের কথা। একইভাবে সৌদি আরবের পবিত্র মসজিদে নববীর খতিব ও ইমাম এবং মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী কর্তৃপক্ষের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মহাসম্মেলনে আসা লাখ লাখ মুসল্লির কণ্ঠে ছিল জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার অঙ্গীকার। অপরদিকে জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনার প্রশংসা করে সারাদেশ থেকে আসা ওলামা-মাশায়েখরা বলেছেন, যিনি দেশ চালাচ্ছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার হাতকে মজবুত করা ইসলামের নির্দেশ। মুসল্লিদের মতে, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন তাই তার কথা শোনার জন্য এসেছি। তিনি দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন। আমরা তার কথা শুনতে এসেছি।’
ইসলামের নামে চলা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো এবং সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় কাজ করার প্রত্যাশা নিয়ে মহাসম্মেলন শেষ হলেও এ ধরনের আয়োজন সর্ব ধর্ম সম্প্রদায় মিলে একসঙ্গে করার প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ কেউ বলা শুরু করেছেন। কারণ ধর্ম নিয়ে বাক-বিত-া ও অসহিষ্ণু আচরণ দূর করার জন্য অপরের ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে এবং বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের গুরুত্ব আজ সর্বজন স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ওইদিন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এখানকার ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষও আছেন এ ভূখ-ে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সব ধর্মের মানুষ তার ধর্ম পালন করবে। সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করছে। আমাদের ধর্ম পবিত্র ধর্ম, শান্তির ধর্ম। এ ধর্মে নিবেদিতরা যেন ঠিকভাবে সব পালন করতে পারেন সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই ধর্মকে কেউ যেন হেয় না করে। মুসলমান ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করবে।’ অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো ও ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের নাগরিক অধিকারের কথাও বলা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে।
দুই. আসলে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের মধ্যে এই মহাসম্মেলন শান্তির বার্তা নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। কারণ ধর্মে ধর্মে বিভেদের পরিবর্তে সম্প্রীতি ও শোষণমুক্ত সুষম সমাজ; অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মঙ্গল কামনায় সম্মেলনের সকলে উজ্জীবিত ছিলেন। লাখ লাখ মুসল্লি একত্রে গেয়েছেন জীবনের জয়গান, মতামত ব্যক্ত করেছেন সাম্প্রদায়িক হানাহানিমুক্ত সুন্দর সমাজ সৃজনের পক্ষে। দেশে দেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার জন্ম হয়েছে তা থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন প্রত্যেকে। উগ্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টির বিকল্প নেই। জামায়াত-বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের ইন্ধনের কারণে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সচেতন মানুষকে ব্যথিত করে। অথচ প্রত্যেক ধর্মের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেন। প্রকৃতপক্ষে মানবধর্মের কথার মধ্যেই আছে ধর্মীয় সম্প্রীতির মৌল ভিত্তি। মহাসম্মেলনের আলোচকরা সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির কথা যেমন বলেছেন তেমনি সম্প্রীতি ভাবনার নানা দিক আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন। মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সাম্যচিন্তা আমাদের সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা। অসহিষ্ণু পৃথিবীর ধর্মীয় মৌলবাদিতা দূর করার জন্য মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আর এর জন্যই দরকার নিজের ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এবং অপর সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলোচনা।
মুসল্লিদের মহাসম্মেলনের মূল সুর ছিল বিশ্বশান্তি স্থাপনে সচেষ্ট হওয়া। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের সমাজ ও সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভিত্তি। এই ভূখ-ে একত্র হয়েছে বহু ধর্ম, এখানে পাশাপাশি বাস করেন নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ। একের মধ্যে বহুর অস্তিত্ব আমাদের সমাজের মতো পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে নেই। এশিয়ায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সংখ্যাধিক্য। তবে বর্তমান বিশ্বে ধর্মের উদার বাণীসমূহ পৃথিবীর সর্বত্রই বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। পরমতসহিষ্ণুতা সকল ধর্মের আহ্বান হলেও, একদল মানুষ সবসময়ই এর বিপক্ষে আছেন। যারা প্রচলিত ধর্ম পালন করেন, তারাও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেনÑ এমন কথা বলা যাবে না। যারা প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করেন না বলে আত্মম্ভরী ঘোষণা দেন, তারাও এক্ষেত্রে শান্তি ও মৈত্রীর কোনো বাতাবরণ নির্মাণ করতে সক্ষম হননি। ফলে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সর্বদা লেগেই আছে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই সুযোগটা গভীরভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজের এই অপপ্রবণতা দেখেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন ওই মহাসম্মেলনের আয়োজন করে। অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টায় ৬ এপ্রিল উজ্জীবিত ছিল ঢাকা শহর।
একথা সত্য, ভারতবর্ষ তথা বাঙালি সমাজে একইসঙ্গে কীর্তন, কথকতা, যাত্রাগান, মৌলবীর কুরআন পাঠ ও ব্যাখ্যা, বাউল, সুফি, দরবেশ, খ্রিস্টান সাধু-সন্ন্যাসীর জীবনাচার সবই বিদ্যমান। এজন্য এখানে ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর বড় নয়, বড় করে তুলতে হবে মনুষ্যত্ববোধ। বিভিন্ন ধর্মের মূল নির্যাস থেকে আমরা জেনেছি প্রচলিত ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে মানবধর্ম বড়। পরমত বা অন্য ধর্মকে সম্মান জানান, সংস্কারমুক্তি ও প্রচলন প্রথার বাইরে গিয়ে জীবনযাপন ও মানবমুক্তির বাণী গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে লোভীর ভেদ-জ্ঞান সৃষ্টির প্রয়াসÑ এসব দূর করতে হবে। মানুষের ধর্মকে বড় করে দেখতে হবে। মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল চিন্তা হবে মুখ্য। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা আমাদের মুখ্য লক্ষ্য। এজন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তারা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি, আলোর মতো, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর; মুসলমানের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানের; খ্রিস্টের শিষ্যেরা বললে খ্রিস্ট ক্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহাম্মদ-খ্রিস্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তিত্ব নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’
তিন. মহাসম্মেলনে আসা লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্বাস করেন, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনো নিরীহ মানুষকে হত্যায় বিশ্বাস করে না। ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে স্থান দেয় না। ইসলাম শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্মে বিশ্বাস করে। ‘শান্তি’ ও ‘ভ্রাতৃত্বে’র এই মৌলভিত্তি আমাদের সম্প্রীতি রক্ষার মূল হাতিয়ার। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক চেতনা চর্চায় প্রচলিত ধর্মের চেয়ে আরেক ধর্ম বড় হয়ে ওঠেÑ যার নাম মানবধর্ম বা মনুষ্যত্ববোধ। মনুষ্যত্ববোধ তথা মানবধর্ম অসাম্প্রদায়িক চেতনারও মূলকথা। সকল ধর্মের প্রতিই থাকতে হবে গভীর শ্রদ্ধাবোধÑ পৃথিবীর সব ধর্মবেত্তাকেই মানবের পরম সম্পদ জ্ঞানে মান্য করেতে হবে, ধর্মগ্রন্থ বা উপাসনালয়ের চেয়ে বড় হলো মানুষ। বিশেষ কোনো ধর্ম নয়, বরং সকল ধর্মের প্রতিই আমাদের ভক্তি ও ভালোবাসা থাকবে অফুরান। ধর্মের নামে যারা জঙ্গিবাদকে মদদ দিচ্ছে তাদের ভেতর এই চেতনা জাগ্রত করতে পারলে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান