চিকিৎসক নারীদের মাতৃত্বকালীন অধিকার নিশ্চিতে বাধা কোথায়?
ডা. জাকির হোসেন
বর্তমানে সারাবিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হলোÑ নারী ও শিশু অধিকারের বিষয়টি। বাংলাদেশও এই নারী অধিকারের বিষয়ে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৯১-এর পর থেকে বলতে গেলে মাঝ খানের কয়েক বছর ছাড়া আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবেই বাংলাদেশ তার সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাকে কর্মজীবী নারীরা সকল ক্ষেত্রে এই সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। এখনো কর্মক্ষেত্র ভেদে নারী তার অধিকার এবং অবস্থানের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছেন। দেশে যারা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা নারী অধিকার বলতে কি বোঝায় বা নারী অধিকারকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন সেই বিধিমালাগুলো একটা ফরম্যাট আকারে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার। আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে যে সকল নারী নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তার কথার পুরো অংশ জুড়েই থাকে নারীরা আজ পুরুষের সমানতালে বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ পুরুষের সমান তালে পারদর্শিতা দেখানো কোনো অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না। কোনো বিষয়ে পারদর্শিতা দেখানো হলো একজন মানুষের দক্ষতা। শুধু মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ফলে মানুষের কিছু অধিকার থাকে সেগুলোকে আমরা মানবাধিকার বলে আখ্যায়িত করে থাকি। তদ্রƒপ প্রতিটি নারী শুধু নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করার কারণে তার কিছু বিশেষ অধিকার থাকে। সে সকল অধিকার সকল বয়সের মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। বিয়ে এবং পরিবার গঠন মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম একটি মাধ্যম। একসময় যখন নারীরা ঘরের কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখত তখন সে এক ধরনের পারিবারিক অধিকারের আওতায় ছিল একজন নারী। পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় নারী-পুরুষ তাদের সন্তান জন্ম দেন, তাদের জীবনের উন্নয়ন ও পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পরিবার হচ্ছে মানব উন্নয়নের সবচেয়ে উপযোগী ক্ষেত্র। আমাদের দেশে প্রচলিত যে সামাজিক কাঠামো রয়েছে তা সমগ্র বিশ্বে অন্যান্য দেশের প্রচলিত সামাজিক কাঠামো থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। হাজারো পরিবার নিয়ে যে কাঠামো এখানে প্রচলিত আছে সঙ্গে নারী-পুরুষ হচ্ছে সেই কাঠামোর মূল অঙ্গ। এদের সবারই যেমন নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে তেমনি সামষ্টিক কিছু দায়-দায়িত্বও রয়েছে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে আজ নারীর কাজের পরিধি বেড়েছে। এই পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর অধিকারের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা অতি জরুরি হয়ে পড়ে।
অনেক দেরি করে শুরু করলেও বাংলাদেশ নারী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে আজকে ক্ষেত্রভেদে এর সুফল পাওয়া শুরু করেছেন নারীরা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মজীবী নারীদের অধিকার একেবারেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রগুলোর অন্যতম হলোÑ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত। স্বাধীনতার পরপর এই দেশে নারী চিকিৎসক ছিল হাতেগোনা কয়েকজন। আজ সেই বাংলাদেশে পুরুষের সমানসংখ্যক নারী চিকিৎসক রয়েছেন। কর্মজীবী নারীদের অন্যান্য খাতে যেভাবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক সেভাবে তো দূরের কথা, স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত নারী চিকিৎসকদের নারী ও মাতৃত্বের অধিকার নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যখাতে যেসব নারী চিকিৎসক কর্মরত তাদের অধিকারের ব্যাপারে কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজ এমনকি রাষ্ট্র একেবারেই উদাসীন। কর্মক্ষেত্রে তাকে সবাই যেমন শুধু চিকিৎসক হিসেবেই দেখছে, তেমনি সমাজ এবং রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাও তাকে চিকিৎসক হিসেবেই দেখছে। সে যে একজন নারী, একজন মা এই দৃষ্টিভঙ্গি কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের প্রায় সকলের মাঝে অনুপস্থিত। নারী চিকিৎসকদের মাতৃত্বকালীন সময়ের ভোগান্তি স্বচক্ষে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবেন না, আমরা সভ্যতার কোন স্তরে আছি। ভোগান্তির শুরুটা হয় একজন নারী চিকিৎসক যখন গর্ভবতী হন। স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। প্রায় সব সরকারি হাসপাতালেই কর্মঘণ্টার চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এই অতিরিক্ত কাজের ভার তার পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। (চলবে-১)
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান