জ্যামে বসে ভারচ্যুয়াল অফিস!
অরুণ কুমার বিশ্বাস
কথিত আছে, মাইক্রোসফ্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস নাকি তার পকেট থেকে কড়কড়ে একশ ডলারের একটি বান্ডিল রাস্তায় পড়ে গেলেও ফিরে তাকান না, কারণ ওটি তুলতে গেলে যে সময় অপচয় হয় তা দিয়ে তিনি ঢের বেশি ডলার কামাতে পারেন। হয়তো অতিশয়োক্তি, তবে এই কথার নিগূঢ় মানে খুব পরিষ্কারÑ টাইম ইজ মানি। সময় যেন এখন জীবনের চেয়েও মূল্যবান। অথচ এই মহা মূল্যবান সময় আমরা নগরবাসী স্রেফ শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিচ্ছি।
অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন অফিসমুখো জনতার অন্তত চার ঘণ্টা কেটে যায় রাস্তায়, যানজটে বসে থেকে তিতিবিরক্ত আর গলদঘর্ম হয়ে শেষে যখন অফিসে ঢোকেন, তখন কাজ করার মতো ইচ্ছে বা তাগত কোনোটিই আর অটুট থাকে না। দামি সময় হেলায় হারিয়ে যায়, গ্যালনকে গ্যালন পেট্রোল পোড়ে, ভিড়ে ভিড়াক্কার লোকাল বাসে চড়ে যারা চলাচল করেন তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। পাটভাঙা জামা দ্বিতীয় দিন পরলে আর মান থাকে না। এসবের পেছনে কে দায়ী? ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজট।
ফেসবুক এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কাজের কাজ কিছু না হলেও অযথা বিরক্তি থেকে নিষ্কৃতি মেলে। যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, তারা টুকুস করে ফেসবুকে লাইক-কমেন্টস ইত্যাদিতে সময় কাটান। কিন্তু মরতে মরণ সেই সানাইঅলাদের সে সুযোগটুকুও নেই। কেননা লোকালবাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে ফেসবুক টেপা যায় না। আবার অন্যভাবে দেখলে শহরের এই দুর্বিষহ যানজটের অন্যতম কারণ। কিন্তু বেশি সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। কোনো কোনো পরিবারে একাধিক বা ততধিক গাড়ি আছে। অথচ পাবলিক বাস অল্প জায়গা দখল করে অনেক বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারে। এসব জানা কথা, আমি ভিন্নতর কিছু বলতে চাই। বাংলাদেশ ডিজিটাল এখন। ফেসবুকের পাশাপাশি আমরা ফলদায়ক উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি। অযথা বসে বসে বিরক্ত না হয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে অফিসের কাজ জ্যামেই সেরে নিতে পারি। এর নাম ভারচ্যুয়াল অফিসÑ আপনি অফিসে নেই, আবার আছেনও। অনলাইনে চিঠিপত্র দেখা থেকে শুরু করে পত্রের জবাব, দিক-নির্দেশনা, দরকারি তথ্যাদি জেনে নেওয়া যায়। চাই কি, দূর মার্কিন মুলুকের কোনো ক্রেতাকে পণ্যের নমুনাও অনলাইনে পাঠানো যায়। আর এসব কাজ করার জন্য অফিস যাবার কী দরকার!সরকার চাইলে অবশ্য শিফটিং পদ্ধতি চালু করতে পারেন। কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যাস করতে পারে। স্কুলে যেমনÑ মর্নিং-ডে-ইভনিং শিফট আছে, দফতরেও তেমনি। সবাই যদি একসঙ্গে অফিসের উদ্দেশ্যে গাত্রোত্থান না করেন, তাহলে ভিড়টাও কম হবে। চীনের তিয়ানজিন প্রদেশে নো-কার ডে সিস্টেম দেখেছি। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামবে না। সবাই পাবলিক বাস ব্যবহার করবে। সেখানে আরও আছে প্রাইভেট গাড়ির নম্বরভিত্তিক ছাড়পত্র ব্যবস্থা। জোড় এবং বিজোড় নম্বরপ্লেটবিশিষ্ট ব্যক্তিগত গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন দিনে রাস্তায় নামবে। অর্থাৎ সর্বমোট গাড়ির অর্ধেকের বেশি একদিনে নামতে পারছে না। অভিনব বুদ্ধি, সন্দেহ নেই।
কিন্তু সেখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। এদেশে অনেকেই খুব বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এদের টাকাকড়িও কিছু কম নেই। নিত্য যাতে আয়েশি সিটে গা ঢেলে দিতে পারে, তাই হয়তো রাতারাতি টাকার জোরে জোড়-বিজোড় দুরকম রেজিস্ট্রেশন নম্বরের গাড়ি কিনে ফেলবে। তাতে জ্যাম উল্টো বাড়বে বৈ কমবে না। যার গাড়ি ছিল দুটো, জ্যামিতিক হারে বেড়ে তা হবে চারটে। কী বুঝলেন!
তাই বলি কী, জ্যাম নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবেন না। ‘ভিড়াক্রান্ত’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হোন। যারা মাখন খাচ্ছে খাক, গাড়ি চড়ছে চড়–ক, আপনি ছুটতে শিখুন। সবচেয়ে ভালো হয়, কষ্ট করে যদি একটু ম্যারাথন রেসটা প্র্যাকটিস করে নেন। তাতে শরীর ভালো থাকবে, আবার জ্যামেও ঘামবেন না। গাড়িতেই যদি না চাপলেন তো রাস্তায় গাড়ির ভিড় নাকি পিঁপড়ের, কী এসে যায় তাতে! সেখানেও প্রবলেম অবশ্য আছে একখানা। শহরে বুক ফুলিয়ে হাঁটার কোনো জো আছে নাকি! ফুটপাত চলে গেছে ফেরিওয়ালার দখলে। উপরি হিসেবে যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। দুদিন মুক্তকচ্ছে হাঁটলেই নির্ঘাত হাঁপানির টান শুরু হবে। একেই বলে শাঁখের করাত। এই আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান