কবি সাযযাদ কাদির : তিনি নেই, তিনি আছেন!
মাহফুজ জুয়েল
‘কবি সাযযাদ কাদির চলে গেলেন। জীবিত কবিদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সাহিত্যের নানা খুঁটিনাটি বিষয় মনে রাখতেন। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, কার কি বই আছে সবই যেন তার ঠোঁটস্থ। আমি নিয়মিত তার স্ট্যাটাস ফলো করতাম শুধু তথ্যের জন্য। এইসব ক্ষেত্রে ওনার তুলনা বিরল। এখন থেকে মিস করব সব!’ এটা কবি সাখাওয়াত টিপুর ফেসবুক স্ট্যাটাস। সাজ্জাদ কাদিরের মৃত্যুতে ফেসবুকে তার মতো আরও অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন। ৬ এপ্রিল ফেসবুকেই প্রথম দুঃসংবাদটি চোখে পড়ল। জানলাম, বাংলা সাহিত্যের ষাটের দশকের অন্যতম কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সাযযাদ কাদির আর নেই।
সাযযাদ কাদিরের জন্ম ১৪ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মিরের বেতকা গ্রামে। তিনি ১৯৬২ সালে বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি করোটিয়া সা’দত কলেজ-এর বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি কলেজের চাকরি ত্যাগ করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৭৮ সালে এটি ত্যাগ করে রেডিও বেইজিং-এ যোগ দেন। ১৯৮০ সালে রেডিও বেইজিং-এর চাকরি ছেড়ে দেন এবং ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় যুক্ত থাকেন। এরপর ১৯৮৫ সালে থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন আগামী-তারকালোক পত্রিকায়। পরবর্তীতে এটি ত্যাগ করেন ও দৈনিক দিনকালে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে দৈনিক দিনকাল হতে ইস্তফা দিয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউটে এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত থাকেন। তিনি ২০০৪ সাল যোগ দেন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। সেখানেই ছিলেন আমৃত্যু। গত ৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সাযযাদ কাদির বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানানুশীলনে আমৃত্যু নিরলস শ্রমিক ছিলেন তিনি। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তার বিচরণ ছিল। ছিল অনন্য সম্পাদনা প্রতিভা ও সাংগঠনিক দক্ষতা। তিনি শুধুমাত্র কবিতাই নয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুতোষ, সম্পাদনা, সঙ্কলন, অনুবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ
কাব্যগ্রন্থ: যথেচ্ছ ধ্রুপদ (১৯৭০); বৃষ্টিবিলীন (২০১২); গল্পগ্রন্থ: চন্দনে মৃগপদচিহ্ন (১৯৭৬); অনুবাদ: লাভ স্টোরি (১৯৭৭), রাজরূপসী, প্রেমপাঁচালী, হারেমের কাহিনী; সংকলন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধসমগ্র; বেগম রোকেয়া প্রবন্ধসমগ্র; পৃথিবীর প্রিয় প্রণয়ী; উপন্যাস: অপর বেলায়; অন্তর্জাল (২০০৮); খেই (২০১২); গবেষণা: রবীন্দ্রনাথ: শান্তিনিকেতন (২০১২); রবীন্দ্রনাথ: মানুষটি (২০১২); প্রবন্ধ: নারীঘটিত (২০১২)। পশ্চিমবঙ্গের নাথ সাহিত্য ও কৃষ্টি কেন্দ্রিক সাহিত্যপত্রিকা ‘শৈবভারতীর ৩৪তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রবন্ধ সাহিত্যে সাযযাদ কাদিরকে শৈবভারতী পুরস্কার দেওয়া হয়।
সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিনে মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি হাসান হাফিজ। গ্রহণ করেছিলেন একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার। সেখানে ‘কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?’ প্রশ্নের জবাবে কবি বলেছিলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম বাংলাদেশ হবে কল্যাণরাষ্ট্র। সমাজে জীবনে থাকবে উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই কল্যাণরাষ্ট্রে এমন এক সরকার থাকবে যে নাগরিকদের সুরক্ষায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। সেখানে সুযোগ ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সাম্য থাকবে। মডেল হবে নোরডিকÑ সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো। কিন্তু কি পেয়েছি? সকালে বা বিকালে শাহবাগে যাওয়ার পথে পরীবাগে দেখি ফুটপাতে অসহায় নর-নারী-শিশুর জীবন। কারওয়ানবাজারে আমার অফিস। রাতে বাসায় ফেরার পথে ভিআইপি রোডের ফুটপাতেও দেখি সেই দুস্থ নর-নারী-শিশুদের। দেখি প্রখর উজ্জ্বল আলোর নিচে কত নিকষ কালো অন্ধকার। গ্রিন রোডে থাকি। এ রোডেরও এখানে-ওখানে ফুটপাতে দেখি ওই নিঃসহায়দের। এই ভুখা-নাঙ্গা ছিন্নমূল মানুষকে দেখব চারপাশে আর শুনব ক্ষমতার রাজনীতির গলাফাটা চেঁচামেচি? না, এমন দেশ আমি চাইনি।’
নেট ঘেঁটে কবির বেশকিছু কবিতা পড়লাম। এর মধ্যে পাঠকের জন্য তার ‘কবির আঙুলগুলো’ কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে দিলাম: ‘…তাহলে এই হাজার বছর শেষে/জীবনের কোন পারে আমরা এখন?/এ এক বধ্যভূমি সামাজিক অবিচারের;/এখানে অর্থ আর অস্ত্রের অন্যায় শুধু।/কবি? আছে। আমাদেরই একজন সে।/এত অপমান অসম্মান, এত রক্তচক্ষু, তবুও/তাকেই ভয় পায় প্রভুরাÑ তার পথে-পথেই/বসায় পাহারা।/কিন্তু কবির আঙুলগুলোতে কত শক্তি/তার শব্দে বাক্যে কত বিস্ফোরক/কিছুই কখনো জানেনি ওরা।/এখনো জানে না/একদিন/সব হুঙ্কার হুমকি তর্জন গর্জন মিইয়ে যাবে/সব হামলার মোকাবিলা হবে/সব হুকুমের হলকুম টিপে ধরবে মানুষ!/এ পৃথিবীতে/সত্য ও স্থায়ী শুধু/জীবন। আর জীবনের কবিতা।’
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান