মাশরাফির অবসর কি নিজ সিদ্ধান্ত?
মোস্তফা মামুন
আমার মনে হয় না অবসরের সিদ্ধান্তটা মাশরাফি নিজে নিয়েছে। আমার ধারণা, সিদ্ধান্তটা নিতে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা যতটুকু জানি বা মনে হয় যে, টিম ম্যানেজমেন্ট মাশরাফিকে চাচ্ছেন না। তারা মনে করছে, আরও তরুণ, উদ্যোমী খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা টি-টোয়েন্টি টিম করবেন। টি-টোয়েন্টি টিম হবে আরেকটু ইয়াং, অ্যাক্টিভ, উদ্যোমী। এ রকম একটা টিম তৈরি করাই ম্যানেজমেন্টের লক্ষ্য বলে আপাত মনে হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আসলে এক ধরনের ভদ্রভাবে বললে, মাশরাফিকে বাধ্য করা হয়েছে সরে যেতে। এখন প্রশ্নটা হলোÑ এই বাধ্য করাটা কি সঠিক হলো? আবেগের জায়গা থেকে যদি চিন্তা করি তাহলে তো ডেফিনেটলি মাশরাফি আমাদের জন্য আইকন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে গত দুই বছরে পরিবর্তন সেটা মাশরাফির নেতৃত্বেই হয়েছে। তবে একই সঙ্গে এটাও আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রায় সব দেশের টি-টোয়েন্টি টিম বলতে গেলে বদলে ফেলা হচ্ছে। সিনিয়র প্লেয়ারদের মধ্যে যারা টি-টোয়েন্টি খেলার উপযোগী নন, আবার যারা টি-টোয়েন্টির উপযোগী যেমন আমদের সাকিব। সাকিবের যে অ্যাবিলিটি সেটা টি-টোয়েন্টির উপযোগী বা তামিম। কিন্তু আমাদের মুশফিক হয়তো বাদ পড়তে পারেন। এই জায়গা থেকে হচ্ছে কোচের চিন্তা। এখন কোচ যে চিন্তা ভাবনা করছেন, যাদের সুযোগ দিচ্ছেন দেখতে পাচ্ছি তারাও পারফর্ম করছেন। তারা যেভাবে পারফর্ম করছেন সেই হিসেবে ইয়ং প্লেয়ারদের সুযোগ দেওয়া। কোচের কোচিং পয়েন্টে এই চিন্তার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু ঘটনা যেটা হচ্ছে, বিষয়টা তো মাশরাফি। আমাদের দেশের ক্রিকেটে মাশরাফির যে ভূমিকা সেটা শুধু ক্রিকেট স্কিল দিয়ে হয় না। মাশরাফির উপস্থিতি, মাশরাফির অনুপ্রেরণায় আসলে পুরো টিমটা মোটিভেট করে, সংগঠিত করে। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, মাশরাফির ক্ষেত্রে পিওর ক্রিকেটিং সেন্স অ্যাপ্লাই না করে তার পারসোনালিটির উপস্থিতিকে মূল্যায়ন করা উচিত। আমার কাছে মনে হচ্ছে সেই জায়গাটায় আমরা ভুল করছি। আমার মনে হয় মাশরাফিকে ফোর্স রিটায়ারমেন্টে না পাঠিয়ে আমরা বরং মাশরাফির নেতৃত্বেই যেন টিমটা থাকে। কারণ মাশরাফির ক্যাপটেন্সি খুব ভালো। মাশরাফি যে পারফর্ম করতে পারছে না তাও না। প্রথম টি-টোয়েন্টিতেও মাশরাফি ভালো বোলিং করেছে। দ্বিতীয় বা সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টিতে নিজে উল্লেখযোগ্য পারফরম না করতে পারলেও দল দুর্দান্ত খেলেছে। জয়ও পেয়েছে। তার মানে তো মাশরাফির অ্যাবিলিটি আছে দলকে দেওয়ার। গত এক বছরে মাশরাফির পারফরমেন্স আরও ভালো।
আমি স্বীকার করছি, টি-টোয়েন্টি টিমে ফিল্ডিং লাগে, ইয়ং প্লেয়ার লাগে, পাওয়ার লাগে উদ্যোম লাগে, একই সঙ্গে লাগে অভিজ্ঞতাও, একটা ইউনিটিও লাগে। দলকে গাইড করতে হয়। নতুন যারা আসবে তাদের একটা ছায়া থাকে। মাশরাফিকে সরিয়ে যে বা যাকে অধিনায়ক করা হবে বলে আমরা চিন্তা করছি সেই জায়গাটা মাশরাফি ছাড়া আর কারও নেই। এটা আমরা দেখেছি, এটা মুশফিকেরও নেই, সাকিবেরও নেই, তামিমেরও নেই। তারা তো আগে ক্যাপটেন্সি করেছে। আমার মতে, মাশরাফির ছায়ায় রেখেই দলকে চালানো যেত। মাশরাফির ক্ষেত্রে রো-ক্রিকেটিং সেন্স অ্যাপ্লাই করাটা ঠিক হয়নি। মাশরাফির উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিতÑ সে করবে না করবে। আমার মনে হয় না এটা খুব ভুল হবে। কারণ মাশরাফি কারও দয়ায় খেলছে না। কারণ তিনি দলের টপ পারফরমার। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট টেকার। গত এক বছর যদি আমরা দেখি মাশরাফির পারফরমেন্স রেগুলার। আমাদের একটা মুশকিল হয়েছে কিÑ মাশরাফির এই ইমোশন, পারসোনালিটির জায়গাগুলো আমরা বড় করে দেখি। এটা দেখে সবার মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মাশরাফি বোধহয় ভালো না খেলেই এমনিতেই দলে আছে। আসলে তা নয়। আমরা যদি ইমোশন বাদ দিয়ে মাশরাফির পারফরমেন্স দেখি তাহলে দেখবেন মাশরাফি কারও চেয়ে কম না। হয়তো একদম শেষ করে দিচ্ছে না, হয়তো মুস্তাফিজের মতো ডেস্ট্রয় করে দিচ্ছে না। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি যখন ১৫০ রান দরকার অপজিশন খুব ভালো করছে তখন দেখবেন যে, মাশরাফির বোলিংয়ে হয় উইকেট নিচ্ছে, অথবা অসম্ভব ভালো ফিল্ডিং করছে। সদ্য শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজ ও টি-টোয়েন্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রো এনে দিয়েছেন। মাশরাফির ক্ষেত্রে ডিসিশনটা এত হার্ড না করে অনেক ম্যাচিউরড ডিসিশন হওয়া দরকার ছিল। আমার ধারণা, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাশরাফি সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। মাশরাফি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য যা করেছে, বিনিময়ে এটা তার প্রাপ্য না। মাশরাফি হয়তো ভেবেছেন, ব্যাপারটা নিয়ে ফাইটে গেলে বিষয়টা বিব্রতকর হতে পারে, সেই জায়গা থেকেই তিনি লড়াইয়ে যায়নি।
বর্তমানে দল নির্বাচনে মাশরাফি অনেক কথা বলছেন, যেমন মাহমুদউল্লাহকে ওয়ানডে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ায় অনেক কথা বলেছিলেন। টিম ম্যানেজমেন্টের হয়তো তা পছন্দ না। এর ফলে হয়তো নতুন কাউকে বেছে নিতে চাচ্ছেন। বলা হচ্ছে যে ক্রিকেটিং কারণে ইয়ং প্লোয়ার দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে তারা এমন একজন ক্যাপ্টেন চাচ্ছেন, যে তারা যেভাবে দলটাকে সাজাবেন সেক্ষেত্রে ওই ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি আসবে না। ফলে মাশরাফি একধরনের বাধ্য হয়েই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গেলেন। এক ধরনের দুঃখ নিয়েও গেলেন এজন্য যে, দেশকে এত সার্ভিস দেওয়ার বিনিময়ে এর চেয়ে আরও বেশি সম্মান পাওয়ার ছিল, সেটুকু না পেয়ে। আমরা কিছুটা অকৃতজ্ঞের মতো, কিছুটা নিষ্ঠুরের মতো তাকে বিদায় দিলাম।
পরিচিতি: ক্রীড়া বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা: আশিক রহমান