বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ কী?
আফসান চৌধুরী
একটা সমাজে একধরনের মতবাদের জঙ্গি থাকে না। বিভিন্ন ধরনের জঙ্গিবাদ তৈরি হতে পারে। এর কোনোটা অর্থনৈতিক, কোনোটা রাজনৈতিক থাকে, কোনোটা সামাজিক। এখন এখানে কিছু ধর্মীয় মানুষকে এনে এক জায়গায় মিলিত হলেই যে জঙ্গিবাদ সমস্যার সমাধান হকে বিষয়টি এমন নয়। সৌদি আরব থেকে মসজিদে নববির ইমাম সাহেবরা এদেশে এসেছেন। প্রশ্ন হচ্ছেÑ সারাদেশের কোথাও, কোনো জায়গায় কি কোনো ইমাম জঙ্গিবাদের পক্ষে বলছেন? আমার তো মনে হয় না। ইমামরা যেটা করেন তারা তাদের বয়ানের মাধ্যমে সমাজের মধ্যে হয়তো তারা সহিংসতা কমান। কিন্তু সহিংসতা মৌলবি বা ইমামদের কথায় কমে না। সহিংসতা সামাজিকভাবেই কমে।
এদেশে জঙ্গিবাদ ইমামদের কথায় শুরু হয়নি, ইমামদের কথায় শেষও হবে না। জঙ্গিবাদ আসলে সামগ্রিক সমস্যা। আমাদের দেশে আমরা অন্য জঙ্গিবাদকে দেখতে চাই না। এটা দেখতে হলে তো গোটা সমাজকে তলিয়ে দেখতে হবে। সেটা আমরা করতে চাই না। মহাসম্মেলন করে কোনো কিছু হয় না। আমি সম্মেলনার উপরে গবেষণা করেছি, অনেক লোককে দিয়ে করিয়েছি। সম্মেলন দিয়ে কোনো লাভ হয় না, জনমত সৃষ্টি হয় না। এতে খুব কমই জনমত সৃষ্টি হয়।
যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তখন দেশ ওই বক্তৃতা গ্রহণ করার জন্য রাজি ছিল। এবং সেটা গ্রহণ করারও উত্তম সময় ছিল। উনার বক্তব্য কিন্তু সফল হতো না যদি জনগণ তার বক্তব্য গ্রহণ করতে রাজি না হতো। বাংলাদেশে এখন এমন কোনো সংকট কি রয়েছে যে, মানুষ মৌলবি বা ইমাম সাহেবদের কথায় ভূমিকা রাখবে। এটা ভালো হতো যদি গ্রামে গ্রামে গিয়ে করা যেত। শহরের মধ্যে বসে এগুলো করে কি লাভ? বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ সমস্যা তো ধর্মীয় নয়। ধর্ম বাংলাদেশে কোনো সমস্যাই না। যেটা হয় এখানে ক্ষমতাবান মানুুষ ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান বড় করার চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোও তাই করে। জঙ্গিবাদ একটা মাইনর সমস্যা। আগেও এখানে এ রকম জঙ্গিবাদের সমস্যা দেখা গেছে। কিন্তু যে জিনিসটা রয়ে গেছে সেটা হলোÑ আমাদের সমাজের অনেকগুলো সংকট নিরসন হয়নি। বৈষম্যের সংকট নিরসন হয়নি। আজকে যদি এই জঙ্গিবাদীরা ক্ষমতায় আসে তাহলে এ সমাজে বৈষম্যের নিরস হবে না। দুস্থ মানুষের অবস্থার উন্নতি হবে না। ইসলামি ফাউন্ডেশন যে সম্মেলন করেছে, সৌদি আরব থেকে ইমামরা সাহেবরা এসেছেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেছেন, এটা ভালো কথা। পৃথিবীর কোনো দেশেই জঙ্গিবাদ বড় কোনো সমস্যা না। প্রত্যেকটা দেশেই জাতীয়তাবাদ সমস্যা থেকেই জঙ্গিবাদের সমস্যার সৃষ্টি। আমাদের দেশে তো কোনো জাতীয়তাবাদী সমস্যা নেই।
জঙ্গিবাদ কিংবা এ রকম দু-একটা গোলাগুলি মারপিট হবেই। এদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত লোক মারা যায় জঙ্গিবাদে দশ ভাগের এক ভাগও মারা যায় না, এমনকি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জঙ্গিও মারা যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় হাজারও মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর দিকে না তাকিয়ে জঙ্গিবাদকেই বেশি গুরুত্ব দিই আমরা। কারণ জঙ্গিবাদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমাদের সংকটা হচ্ছেÑ রাজনৈতিক। যে সমাধানটা দরকার বাংলাদেশের জন্য এটা কখনো আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। কখনো আমরা মৌলবি দেখাই, কখনো আমরা সুশীল সমাজ দেখাই, কখনো আমরা নাচ-গান করি, কখনো-বা আমরা বৈশাখী উৎসব করি। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছেÑ রাষ্ট্র পরিচালনার যে কাঠামো সেটা কি তৈরি করতে পেরেছি? না, সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগ, বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনিÑ কিভাবে জাতীয় নির্বাচন করবে।
মৌলবি বা ইমাম সাহেবদের জন্য তো আর জঙ্গিবাদের সমস্যা হয়নি। সাধারণ মানুষের চেয়ে একজন মৌলবি কখনোই ভালো জানে না। এগুলো মৌলবিদের না জিজ্ঞেস করে সাধারণ মানুষদের জিজ্ঞেস করলে তারাও বলতে পারবে। এই মৌলবি দেখানোর কারণ হচ্ছে লোক দেখানো। আওয়ামী লীগ আসলে সবার ভোট চায়। আওয়ামী লীগ দেখাচ্ছে যে, তারা ধর্মবিরোধী নয়। এটা খুব নাজুক একটা বিষয়। আমি যেহেতু ভোট চাই না, আমি যা কিছু বলতে পারি।
আমাদের দেশের অন্যান্য সমস্যার কাছে জঙ্গিবাদ খুবই ছোট একটা সংকট। আমরা যে পরিমাণ টাকা খরচ করছি জঙ্গিবাদ আটকাতে, তা কল্পনাও করা যায় না! হলি আর্টিজান ছাড়া জঙ্গিবাদীরা কোথায় সফল হয়েছে? হলি আর্টিজানের আগে ছোটখাটো জঙ্গিবাদী তৎপরতায় সরকার কিছুই বলেনি কিংবা করেনি। হলি আর্টিজানে আঘাত করার পর বা বড়লোকের উপরে আঘাত করার পর সরকার নড়েছে। এটা তো পরিষ্কার আমাদের সরকার যাদের কথা বেশি চিন্তা করে তারা কারা। সেখানে বড় লোকদের উপর যেহেতু আঘাত করেছে, এ দেশের রাষ্ট্র যেহেতু বড়লোকপন্থি সেহেতু জঙ্গিবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বাংলাদেশে। মৌলবি বা ইমাম সাহেবদের আনলেও জঙ্গিবাদের ভবিষ্যৎ নেই। না আনলেও জঙ্গিবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এখানে।
পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা: আশিক রহমান