কৃষির সঙ্গে সৌরবর্ষপঞ্জির একটা সম্পর্ক আছে বলেই নববর্ষ এত গুরুত্বপূর্ণ
কৃষি সভ্যতা, যারা নদীর উপাসনা করত, কারণ কৃষির জন্য নদী প্রধান শর্ত, তারা যত জায়গায় ছড়িয়েছে, তত জায়গাতে নদীর নাম গাঙ হয়েছে, তারই আর্যীকৃত রূপ গঙ্গা। অস্ট্রিক এই জনগোষ্ঠী বা ভাষাপরিবার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা খুব মুশকিল, কারণ পরস্পরকে খারিজ করা বিরোধী অনেক বক্তব্য ভাষাবিদদের আছে। কিন্তু একটা বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত, এমনকি আর্যরা এইখানে আসার আগেই নদীকে গাঙ বলা হতো, নদীর পূজা করা হতো পবিত্র জ্ঞানে। আর্যরা সেই সংস্কৃতি কেবল গ্রহণ করে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই ‘অস্ট্রিক’ জনগোষ্ঠীর বাংলা কিংবা ভারতে অনেকগুলো ঢেউ আসার সম্ভাবনাও আছে, হয়তো তারা কোনোবার এসেছে প্রাককৃষি জনগোষ্ঠী হিসেবে, কোনোবার কৃষির জ্ঞান নিয়ে। কিংবা কাছাকাছি সময়েই অনেকেই হয়তো কৃষি সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। তবে যোগাযোগ যে ছিল, তার বহু প্রমাণ আছে।
প্রাকমোঘল বাংলাতে, এমনকি প্রাক মুসলিম বাংলাতেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে নৌ-বাণিজ্যের নানান নিদর্শন আছে। আবার তামিলনাড়ু, সিংহলের মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও একই সময়ে নববর্ষ পালনের অর্থ, দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মাঝেও এই বর্ষপঞ্জির সূচনার সম্ভাবনা আছে। কে কার থেকে গ্রহণ করেছে নাকি একই জলবায়ুতে নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে বর্ষা ঋতুর পূর্ববর্তী গ্রীষ্মকে চিহ্নিত করা হয়েছে নববর্ষ হিসেবে, সেসব নিশ্চয়ই পুরাতাত্ত্বিক-ইতিহাসবেত্তারা অনুমান করতে পারবেন। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জি যে নতুন কিছু না, এটা নিশ্চিত। কারণ, কৃষি সভ্যতা। কৃষির সঙ্গে সৌরবর্ষপঞ্জির একটা সম্পর্ক আছে বলেই নববর্ষ এত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষির একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বিকাশ সূর্যের গতিবিধি সম্পর্কে মোটামুটি নিখুঁত জ্ঞান দাবি করে। এই চাহিদা থেকেই সৌরবর্ষের জন্ম। খুব প্রাচীন সৌরবর্ষ যেমন মিশরিয়দের, মেসোপটেমীয়দের। কৃষির প্রয়োজনেই এটার প্রয়োজন হয়েছে। মিশরিয় পঞ্জিকাকে গ্রহণ ও পরিমার্জন করা হয়েছে বহুবার, জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি আসলে এই সংস্কারের স্মারক, উদ্ভাবকের স্মৃতি না। নৃ-পতিরা প্রায়ই এই বর্ষপঞ্জিতে নিজেদের ছাপ মেরে দিতেন। সেটা তাদের ক্ষমতারই ছাপ আসলে। ইরানি সৌরবর্ষপঞ্জির সংস্কারে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন গণিতবিদ ওমর খৈয়াম, সেটাও পৃষ্ঠপোষক রাজার নামেই চলেছিল। কিন্তু, এর মানে এই না তিনি এর প্রচলন করেছিলেন। কৃষির প্রয়োজনে সৌরপঞ্জি আগেই ছিল, খাজনার প্রয়োজনে সেটার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, এই টুকুই হয়তো আকবরের কৃতিত্ব।
ফলে, কাছাকাছি সময়ে অঞ্চলজুড়ে নববর্ষ পালনের তাৎপর্য বিশাল হতে পারে। এর একটা সম্ভাব্য ইঙ্গিত এই হবার কথা যে, এই জনগোষ্ঠী, যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও, অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠী আর ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হলেও কোনো একটা বা একাধিক কৃষিসভ্যতার তারা হয়তো উত্তরাধিকারের স্মৃতি বহন করছে। এই বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানি না। কিন্তু ইতিহাসে বহুবার আমরা দেখেছি বাকি সব যোগাযোগ ঘটনাপ্রবাহে হারিয়ে গিয়ে একদম স্বতন্ত্র বহু জাতি গড়ে উঠলেও, এমনকি আদি সভ্যতাটি হারিয়ে গিয়েও তার জ্ঞানের বহু উত্তরাধিকার টিকে থাকে। যেমন, ফোনেসিয়রা বিলুপ্ত হলেও তাদের লেখন পদ্ধতি টিকে গেছে।
কিন্তু আরও কিছু পর্যবেক্ষণ জানাই। জনপ্রিয় ইতিহাসের শক্তি সম্ভাব্য অন্য ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি। মুসলমানের গর্ব আকবরে, মুসলমানের আগমনের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের সম্পর্কে। হিন্দুর কাছে এটা তার নিত্যপূজার স্মারক, মুসলমান তো সেখানে ভিনদেশি সংস্কৃতির বাহক মাত্র। এই পরস্পরকে অপর বা পর ভাবার মাঝেই সংস্কৃতির বিপদ, আজও যেন সুক্ষ্ম স্তরে মুসলমানে-বাঙালিতে সেই শরৎচন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। নওরোজ প্রাক-মুসলমান পারস্যের উত্তরাধিকার, এই কারণেই আরবদের সঙ্গে পার্থক্য দেখাতে, কিংবা নিজেদের সাংস্কৃতিক সম্পদের প্রদর্শনী হিসেবে ইরানিরা বেশি বেশি নওরোজ পালন করে।
শেষ আরেকটা কথা। চাপিয়ে দিয়ে তা কখনোই বাস্তবায়ন করা যায় না, যা বাস্তবায়নের অযোগ্য না। অন্যদিকে যা ক্রমান্বয়ে নিজেই বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাকে চাপিয়ে দিয়ে অহেতুক যা ঘটছিল, তাকে বিতর্কিত করারও প্রয়োজন একদম নেই। বরং, সাংস্কৃতিক নানা উদ্যোগ আর সংস্কারেই তা মানুষ আরও সহজভাবে পালন করতে পারে, পারে সাধারণ মানুষের হাতে খরচা করার মতো কিছু বাড়তি অর্থের জোগান ঘটলে। কিন্তু আমরা কেবল এই দেখছি, হেফাজত আর বাঙালিয়ানা, উভয়েরই চাপিয়ে দেওয়া কী ভীষণ পুতুলনাচের আওয়ামী বাজিকর।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন/ফেসবুক থেকে