‘কী সব্বেনেশে কথা, পশ্চিমবঙ্গ কী মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছে!’
মাঝে মধ্যে কোনো কোনো কাগজের খবরে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। প্রথম আলোর একটি খবর পড়ে তো মাথা আউলা হবার যোগাড়। তাদের সেই খবরের শিরোনাম, ‘পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ মাদ্রাসায় অমুসলিম শিক্ষার্থী বেশি’। এমন শিরোনামে মাথা আউলা না হয়ে পারে! প্রথম আলোর মতোন এমন একটি স্বনামধন্য ‘সেক্যুলার’ কাগজ এ ধরনের একটি ‘কম্যুনাল’ বিষয়ে খবর করল কী করে! ‘মধ্যযুগীয়’ মুসলিমদের ততধিক পিছিয়ে পড়া মাদ্রাসা নামক ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী করে অমুসলিমরা পড়ে, তাও আবার ভারতাধীন পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি প্রগতিশীল জায়গায়! তাদের কী প্রাণের ভয় নেই, চাপাতির কোপ খাওয়ার ভয় নেই! না কি তারা ‘চাপাতি’ কে ‘চা-পাতি’ মনে করে আদা চা’ করে খায়! কিছু কিছু ফেসবুকার ও লিখিয়েদের ভাবনাগুলো হয়তো এমনি বিস্ময়কর।
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! খবরের ভেতরে ঢুকে যখন দেখলাম প্রথম আলো খবরটি করেছে কলকাতার ‘মেগা সেক্যুলার’ ‘আনন্দবাজারে’র বরাত দিয়ে। অবশ্য খবরটির কিছুটা ‘সেক্যুলার’ রূপ দিতে প্রথম আলো শুরুতেই বলেছে, ‘পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলোতে চালু হয়েছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি বিজ্ঞান, বাণিজ্যও শেখানো হয় এখানে। পাশাপাশি ১০০ নম্বর রাখা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য।’ খবরের কথাগুলো দেখুন, ‘মাদ্রাসাগুলোতে চালু হয়েছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা।’ অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা যে আধুনিক নয় তা পরোক্ষভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, কৌশল্যে থেকেছে মধ্যযুগীয় শব্দটি। জানি না এটা আনন্দবাজারীদের বাক্যবিন্যাস, না প্রথম আলোর। তবে এই বাক্যবিন্যাস নিয়ে ঢাকার ভানুর মতো দুটি প্রশ্ন বুদবুদ কাটছে মাথার ভেতর। অভয় দিলে বলি, প্রথমত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যদি অনাধুনিক হয়, তাহলে ‘সংস্কৃত’ শিক্ষা কী? দ্বিতীয়ত, যারা প্রতœতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন, হাজার হাজার বছরের আগের পুরাকীর্তি খুঁজে বেড়ান তাদের এই পড়াশ্রম কী প- নয়? মহেঞ্জোদারোর ‘গপ্পো’ নিশ্চয় ২০১৭ সালের নয়!
‘বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি বিজ্ঞান বাণিজ্য’ শেখালেই কী শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক হয়ে যায়! যারা শুধু ‘লিটারেচার’ পড়ে তারা কী গাড্ডায়! বাংলা সাহিত্য আর ইংরেজি লিটারেচার’ কী মধ্যযুগের পর থেকে শুরু হয়েছে! যারা ‘পদাবলী’ পড়ে তাদের কী বলবেন! দেখুন দেখি অবস্থা। ভয়েই বলি, আধুনিকতার তকমা যারা সাটেন তারা শিক্ষাটা যে কী জিনিস তা সত্যিকার অর্থেই জানেন! শিক্ষার সঙ্গে ব্যবস্থাকে কীভাবে জুড়ে দিলে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয় সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে? উপরোক্ত গোলমেলে বাক্যবিন্যাসে তো মাথাই গোলমাল হয়ে যাবার দশা। গোলমালে গুলিয়ে যাওয়া চোখে যখন দেখি ‘আধুনিক মাদ্রাসা’ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের মতো ‘মধ্যযুগীয়’ একটি ধর্মের জন্য একশ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে, তখন তো বিস্ময়ে ভিড়মি খাবার অবস্থা।
অথচ এটুকুতেই যদি বিস্মিত হই, ভিড়মি খাই তবে ‘অমুসলিম’ শিক্ষার্থীদের বিষয়টি নিয়ে কথা আগে বাড়লে তো রীতিমতো ‘হেমারেজ’ হয়ে যাবে। একটা সংখ্যা বলি প্রথম আলোর ভাষাতেই, ‘ওড়গ্রাম মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ২৩০। এর মধ্যে অমুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮০০।’ মুসলমানদের মাদ্রাসায় তো অন্য ধর্মের বিষয় পড়ানোর কথা নয়। তাহলে এই আটশ অমুসলিম শিক্ষার্থীদের কী ইসলাম ধর্মই পড়তে হয়? ব্যাপারটি অবশ্য পরিষ্কার করেনি প্রথম আলো কিংবা আনন্দবাজারীরা। ধর্মের একশ নম্বর বাদ দিয়ে তো আর পরীক্ষায় বসা সম্ভব নয়। তাহলে তো ধর্ম পড়তেই হয়! কী ভয়াবহ ঘটনা! মুসলমানদের মাদ্রাসায় পড়ে এরা তো মধ্যযুগীয় হয়ে যাবে! হিজাব, নেকাব, দাড়িতে তাদের কেমন দেখাবে? ‘কী সব্বনেশে কতা! একন কী হপে গো?’
কথায় কথায় যারা শিক্ষার আগে আধুনিক শব্দটা যোগ করেন তাদের ভেবে দেখা উচিত মায়ান, গ্রিক, ব্যাবিলনিয় সভ্যতা এসব কিন্তু মধ্যযুগ পরবর্তী নয়, ইসলামেরও আগে। গ্রিক মিথোলজি পড়া যদি ‘কালচারাল’ হবার, ‘মডার্ন’ হবার প্রমাণ হয় তাহলে ‘মধ্যযুগ’টা কী দোষ করল! বেদ, গীতা, বাইবেল জানা যদি জ্ঞানের উৎকর্ষতা হয় তাহলে কুরআন নয় কেন? উপমহাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃত চর্চার পাদপীঠ ‘নালন্দা’ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসে যাদের হৃদয় কাঁদে, এর উপরে লিখে যারা ‘জ্ঞানপীঠ’ হয়ে যান তাদের তো কেউ ‘অনাধুনিক’ বলে না! কেন বলে না, এমন প্রশ্নে যে বৈপরীত্যের সম্মুখীন হতে হয় তার কী উত্তর?
আমরা যে জ্ঞানের বহুতল ভবনের উপর বসে আছি তার ভিত কিন্তু নিচ তলায়। আমাদের এবং আমাদের জ্ঞানসহ সকল ওজন ধরে আছে সেই গ্রাউন্ড ফ্লোরই। বর্তমানের ভিত অতিতেই। অতীতকে জানার মধ্যে কোনো অনাধুনিকতা নেই। সর্বোপরি শিক্ষা শব্দটির সঙ্গে ‘অনাধুনিক’ শব্দটি যায় না, শিক্ষা শিক্ষাই। সোজা ভাষায় বললাম, কোনো ‘কেলো’ নয়। কেউ যদি তাত্ত্বিক আলোচনা করতে চান করতে পারেন। তবে বৃত্ত ঘুরে ফিরতে হবে বিন্দুতেই। কথা পরিষ্কার।
পুনশ্চ: কেউ ভাববেন না, শুধু মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনাধুনিক বলায় আমার এই উষ্মা। আমার উষ্মা কোনো শিক্ষাকে অনাধুনিক আখ্যায়িত করাতেই। নিজে কদিন ধরে গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ‘মোক্ষযোগ’ পড়ছি। সেখানে অর্জুনকে বাসুদেব বলছেন, ‘আর যে বুদ্ধি অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন (অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে আবৃত) হইয়া অধর্মকে ধর্ম ও সমস্ত পদার্থ বিপরীতরূপে প্রতিপন্ন করে, তাহা তামসী।’ এখন আমাকে যদি কেউ বলে আপনি ‘অনাধুনিক’ তাহলে করার কী আছে! গ্রিক মিথোলজিতে নার্সিসাস একটি অদ্ভুত চরিত্র, যে কি না নিজের প্রেমে পড়ে আত্মঘাতী হয়েছিল। সেই থেকে মনোবিদ্যায় যোগ হয়েছে ‘নার্সিজম’ শব্দটি। এটি একটি মনোবৈকল্যের নাম। এতে আক্রান্ত মানুষেরা নিজেতে মুগ্ধ হয়ে নিজের চিন্তাকেই সত্যি বলে ভাবেন। তিনি বা তারা যা বলেন, করেন তাই ঠিক। যেন ‘এ জগতে তারাই সত্য, এর থেকে বেশি কিছু নেই!’ আত্মপ্রেমে মগ্ন এমন যদি কেউ বা কারা নিজকে ‘আধুনিক নার্সিসাস’ ভাবেন, তাহলেও বা করার কী আছে!
ফুটনোট: এ যুগের ‘নার্সিসাস’দের সঙ্গে সম্পর্কযোগ বের করা যায় কি না জানি না, তারপরেও একটি গল্প বলি। এ ভদ্রলোক ব্রিটেন থেকে আমেরিকা গিয়েছেন। ব্রিটেনে গাড়িগুলো রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ, আর আমেরিকায় লেফট হ্যান্ড। ব্রিটিশ তো আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। এমন সময় ব্রিটিশের ‘ব্রিটিশনি’ মানে স্ত্রী তাকে ফোন করে বলল, রেডিওতে বলছে তুমি যে রাস্তায় যাচ্ছ সে রাস্তায় নাকি এক পাগল উল্টো দিকে গাড়ি চালিয়ে বিশাল ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ স্ত্রীকে বলছে, তোমার রেডিও তো একজনের কথা বলছে, আমি তো দেখছি সবাই উল্টো দিকেই গাড়ি চালাচ্ছে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান