সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সর্বধর্মীয় মহাসম্মেলন করা উচিত
শাহরিয়ার কবির
…জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সম্মিলিত সম্মেলন হতে হবে। এটা শুধু ইমামরা করলেই হবে নাÑ ইমামদের সঙ্গে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাইকেই থাকতে হবে এখানে। সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে, জ্ঞানী মানুষদের নিয়ে একটা মহাসম্মেলন হতে পারে। আমাদের এখানে যেমন ইসলামি মৌলবাদ বাড়ছে, ভারতেও তো হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। গরু জবাই করলে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে…
ইসলামী ফাউন্ডেশন আয়োজিত একটি সম্মেলন-এ যোগ দিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলেছেন সৌদি আরব থেকে আগত মসজিদে নববির ইমাম সাহেব সহ অন্যরা। এটা ইতিবাচক। ইসলামি চিন্তাবিদ, আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা যদি এখানে সিরিয়াসলি কাজ করেন জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে তাহলে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। জঙ্গিরা ইসলামের নামে যা করছে তা যে সঠিক নয়, জঙ্গিবাদ কোনো ইসলাম নয়, ইসলাম এসব কর্মকা- অনুমোদন করে না এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম এসব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে সচেতন হবে। জঙ্গিবাদীরা চাপে পড়বে। এমনটি করতে পারলে নিশ্চয়ই সম্মেলনে আলেমরা যা বলেছেন, এটার একটা প্রভাব পড়বে জঙ্গিবাদে যারা আসতে চায় বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের উপর। যেমন আমি খবরের কাগজে দেখলাম, এক বাবা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন ওই মহাসম্মেলনে। মেয়েটা একটু বেশি উগ্র হয়ে যাচ্ছিল। এটা শোনার পরে মেয়েটা বলেছে, না ওই বিপথে যাওয়া যাবে না। এখন সে বুঝতে পেরেছে ইসলাম এগুলো অনুমোদন করে না সন্ত্রাস, হত্যা বা জঙ্গিবাদ। সৌদি মেহমান আনার উদ্দেশ্য যদি হয় ভালো তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু এটাকে যদি রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন আবার উল্টো প্রতিক্রিয়া হবে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আলেম সমাজের অবশ্যই একটা বিরাট ভূমিকা থাকা উচিত। সরকারেরও উচিত হবে তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো। এটা একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি থেকে বহুবার বলেছি।
অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য থাকলে সেটা নিশ্চয় সমালোচনা করতে হবে। সেটার ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। একটা দেশের বিরুদ্ধে বা একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ইসলাম কখনো তা অনুমোদন করে না। এ কথাটি আমি বললে যতটা না কাজে লাগবে, তার চেয়ে বেশি কাজ হবে যদি একজন ইসলামি চিন্তাবিদ বা আলেম সাহেব বলেন। সেটাই বেশি কার্যকর ফল দিবে। সেদিক থেকে ইসলামি ফাউন্ডেশনের এই মহাসম্মেলনকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এটা দিয়ে আমি জাস্টিফাই করব সরকার পাঠ্যসূচির যে সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছে, হিন্দু লেখকদের লেখা বাদ দিতে হবে। না এটাও ইসলামের কথা নয়। ইসলামের কথা হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন পর্যন্ত যাও। চীনের তো ওই সময় ইসলামি জ্ঞান ছিল না, ওটা নাস্তিক জ্ঞান ছিল, ওটা বে-ধর্মী জ্ঞান ছিল, কাফেরদের জ্ঞান ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যদি কাফেরদের জ্ঞান শেখার জন্য তার উম্মতদের নির্দেশ দিয়ে থাকেন, সাহাবাদের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আজকে আমি হিন্দু লেখক বলে তাদের লেখা পড়ব না, এটা তো ইসলামবিরোধী চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংবিধানবিরোধী চেতনা তো বটেই। একই সঙ্গে ইসলামের মূল শিক্ষারও বিরোধী এটা।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সম্মিলিত সম্মেলন হতে হবে। এটা শুধু ইমামরা করলেই হবে নাÑ ইমামদের সঙ্গে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাইকেই থাকতে হবে এখানে। সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে, জ্ঞানী মানুষদের নিয়ে একটা মহাসম্মেলন হতে পারে। আমাদের এখানে যেমন ইসলামি মৌলবাদ বাড়ছে, ভারতেও তো হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। গরু জবাই করলে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। এটা তো দেখলাম যে ভারতের কোনো এক প্রদেশে আইন হয়ে গেছে। এগুলো তো সাংঘাতিক উদ্বেগজনক। ইউরোপ-আমেরিকাতে খ্রিস্টান ফান্ডামেন্টালিজম যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, সে জন্য আমার নিজেস্ব মত হচ্ছেÑ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যদি গ্লোবাল একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় তাহলে সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে এক বা একাধিক সম্মেলন করতে হবে। সব ধর্মের মূল কথাটাই তো হচ্ছে মানবতা। নবীরা তো সবাই মানুষকে ভালোবাসার কথা বলেছেন। স্রষ্টা তো সব ধর্মকে সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টা তো পার্টিকুলার একটা ধর্মকে সৃষ্টি করেননি বা একজন নবীকেই শুধু পাঠাননি। কুরআনে আছে, আল্লাহ সব জাতির জন্য নবী পাঠিয়েছেন। ১ লাখ ২৪ হাজার জন।
ভারতে এখন যেটা হচ্ছে হিন্দু পুরোহিতদেরও তো সামনে আসা দরকার। এ বিষয়ে তাদের কথা বলা উচিত। যারা গরু জবাই করলে ফাঁসির কথা বলছেন তাদের বোঝানো উচিত যে, আপনারা হিন্দুত্বের নামে যা করছেন এটা তো আসলে হিন্দু ধর্মে নেই। আপনি গরু নিষিদ্ধ করছেন আগে তো গরুর/গমের যজ্ঞ ছিল। কারণ ভারতবর্ষের রাজারা তো গরুর/গমের যজ্ঞ করেছেন। গরু পাচার করে দেবতাকে উৎসর্গ করা হতো। তার মানে এই না যে গরু জবাই করলে তাকে মেরে ফেলতে হবে। এখানে সাম্প্রদায়িকতাই মাথাচাড়া দিবে। হিন্দু ধর্ম যেখানে সবার উপরে মানুষ সত্য বলা হচ্ছে। সেজন্যই দরকার সর্ব ধর্মীয় সম্মেলন। আমরা এবার যে রকমভাবে আইপিইউ সম্মেলন করলাম। এ রকম সারা পৃথিবী থেকে ইসলামি চিন্তাবিদ, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আরও অন্যান্য ধর্মের যারা ধর্মীয় নেতা বা ধর্মীয় নীতিনির্ধারক রয়েছেন তাদের নিয়ে সম্মেলন হওয়া দরকার।
বার্মাতে যেটা হচ্ছে সেটা তো বুদ্ধিস্টরাই করছে। বৌদ্ধ ধর্মের নামে এটা করছে। এখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মংদের একটা … আছে। এই অসহিষ্ণুতা এখন সব ধর্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ইসলামের মধ্যে অবশ্যই বেশি। সেজন্য ইসলামের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মধ্যেও এই অসহশীলতার জায়গাটা দূর করতে হবে। বোঝাতে হবে কোনো ধর্মই এটাকে সমর্থন করে না। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য। এর মধ্যে ধর্ম, পরকাল, ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই।
পরিচিতি: ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান