মৈত্রী এক্সপ্রেস-২ এবং তিস্তার পানি
অরুণ কুমার বিশ্বাস
শুরুটা ছিল চমৎকার। ৮ এপ্রিল সকাল আটটায় খুলনা থেকে বেনাপোল হয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল পুষ্পশোভিত মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন-২। মাননীয় রেলমন্ত্রী উড়ালপথে যশোর হয়ে বেনাপোল আসবেন। সেখানেই দুদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীদ্বয় দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন করবেন খুলনা-কলকাতা মৈত্রী ট্রেন-২, যা কি না এ অঞ্চলের ভ্রমণপিপাসু জনগণের অনেক দিনের প্রত্যাশা ছিল।
সৌভাগ্যবশত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমিও শামিল হলাম। সাজ ছিঁড়ে যাবে, তাই সীমিত গতিতে ট্রেনটি খুলনা থেকে বেনাপোল এলো আড়াই ঘণ্টায়। ততক্ষণে বেনাপোল সীমান্তে উৎসুক জনতার ঢল নেমেছে। উদ্বোধন পর্বটি যথেষ্ট জাঁকালো ছিল, তবে ক্ষণের বিচারে তত প্রলম্বিত নয়। কারণ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর নববার্তা নিয়ে ট্রেন ছুটে যাবে কলকাতার চিৎপুর স্টেশনে। উদ্বোধনপর্ব সারা হতেই আমরা ট্রেনের অভিযাত্রীরা যার যার কেবিনে গিয়ে বসে পড়ি। বাইরে প্রচ- দাবদাহ, তাই চাইলেও আলোতে তিষ্ঠানো যায় না। ঢুকুর ঢুকুর করে ট্রেন পেট্রাপোল এসে থামলো। এখানেই পাসপোর্টে সিল পড়বে, মানে আমরা ঢুকে পড়ছি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চৌহদ্দিতে। গিয়ে দেখি এলাহী কা-। মিডিয়ার মেলা লোকজন এসে ভিড় জমিয়েছে। আতিথেয়তারও কমতি নেই। সত্যি বলতে, এই প্রথম কলকাতায় যাচ্ছি তো, কৌতুহল ছিল তবে খুব একটা আলাদা কিছু দেখছি না। পুলিশের উর্দিতে খানিক ফাঁরাক, মানুষজন সব মোটামুটি একই রকম দেখতে।
ট্রেনের গতি সীমিত, কারণ মৈত্রী বা বন্ধুত্বে তাড়াহুড়ো করতে নেই। মমতা ব্যানার্জির শহরে যাচ্ছি, শুনেছি তার অনেক ক্ষমতা। চাইলেই তিনি তিস্তার কিছু একটা বিহিত করতে পারেন। তিস্তার পানিÑ মিঠা বলে জানি। মনে মনে এক টুকরো গৎও বেঁধে ফেললাম। হরিষে বিষাদ, এবারেও নাকি তিস্তার পানি নিয়ে যে কষ্ট, তার থেকে নিস্তার মিলছে না। মান্যবর নরেন্দ্র মোদি অবশ্য আশ্বস্ত করছেন, হবে হবে, তিস্তার পানির কিছু একটা সুরাহা নিশ্চয়ই হবে। বাংলাদেশকে আমি হতাশ করব না।
বনগাঁ গিয়ে ট্রেন আবার থামলো! কী ব্যাপার-কী হলো? কলকাতা রেলের পক্ষ থেকে মধ্যহ্নভোজন করাবেন। একটি বগিতেই আসন পাতা হয়েছে। খাসা আয়োজন। রুই-পাবদা থেকে শুরু করে কারি-কুক্কুট (মানে মোরগ), সবজি, হরেক রকম মিষ্টি-দই সব আছে। বাহারি এন্তেজাম যাকে বলে! নাহ্ এতটা আমি অন্তত আশা করিনি। তার মানে মমতাজী সত্যিই এবার সদয় হয়েছেন আমাদের প্রতি। তিনি উপলব্ধি করেছেন, শুধু ক্ষমতা নয়, মমতা দিয়েও তিস্তার আশু সমাধান সম্ভব।
পথে পথে উৎসুক জনতা ভিড় করছে। দেখছে নতুন মৈত্রীর হেলেদুলে ছুটে চলা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এদের অনেকেরই শিকড় এপার বাংলায়। ভাগ্যের ফেরে হয়তো বাপ-ঠাকুরদার ভিটামাটি ছেড়ে সরে যেতে হয়েছে। কিন্তু দেশের মাটির প্রতি যে মমতা ও টান, তা কি ফিকে হয়েছে একটুও! কেউ কেউ জোড়হাতে প্রণাম জানাচ্ছে, যেন এটা ট্রেন নয়, বাংলাদেশের সোঁদামাটির গন্ধ মেখে আসছে।
বনগাঁর পর বারাসত, তারপর দমদম হয়ে কলকাতা স্টেশন। নতুন ট্রেন আসছে বলেই হয়তো সবখানে সাজ সাজ রব। এই উপলক্ষে নিরাপত্তার অভাব ছিল না কোনো। প্রচুর রেল সুরক্ষা বল-এর উপস্থিতি দেখা গেল। এরা সব সশস্ত্র কমান্ডো, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম। ঝঁকঝঁকে তকতকে ও যথেষ্ট সুপরিসর কলকাতা রেলওয়ে স্টেশন। দেখে সত্যি চোখ জুড়ায়। সেই তুলনায় আমাদের কমলাপুর স্টেশন কি একটু ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিত! রেলওয়ের বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জানালেন, হবে, আমরাও উন্নতির পথে হাঁটছি। শুনে বেশ ভরসা পেলাম। কলকাতা নামতেই কানাঘুষায় শুনি, আমজনতা তিস্তা নিয়েই কথা বলছে। মমতা কি এবার একটু নরম হবেন, নাকি সেই তোর্সা ও অন্যান্য ছোটনদী দেখিয়ে দেবেন! ভারতীয় টিভি চ্যানেলে চোখ যায়। মোদিজি স্পষ্টই বললেন, তিস্তা নিয়ে ভাবতে হবে না। তিস্তা বাংলাদেশের জন্য সুপেয় পানি নিয়েই ঢুকবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আশাতেই বাঁচি। তিস্তা নিয়ে যে স্বপ্ন, আশা করি তাও বাস্তব হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান