প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর : প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি
ইনাম আহমেদ চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে অনেক করেছেন নিঃসন্দেহে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আমাদের প্রাপ্তি বা অর্জন কী সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি আমরা। যে ৬টি চুক্তি ও ১৬টি সমঝোতা হয়েছে। ৬টি চুক্তি আর ১৬টি সমঝোতা থেকে বাংলাদেশের প্রয়োজন মতো কী হয়েছে সেটা এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। কেননা চুক্তি এবং সমঝোতার বিবরণ এখনো এখনো আমরা বিস্তারিত পাইনি বা জানি না।
আমাদের সামরিক চুক্তির কি কোনো প্রয়োজন আছে? আমাদের প্রয়োজন অনুসারে যদি করে সেটা অন্য জিনিস। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটোÑ ভারত এবং মিয়ানমার। আমরা তো আর পরাশক্তি নই যে আকাশ এবং সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা যুদ্ধ করতে যাব। আমাদের সমস্যা হলোÑ বর্ডার বা উপকূলীয় সমস্যা। আশেপাশের দেশের সঙ্গে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ভারত-মিয়ানমার আর বড়জোর থাইল্যান্ডের সঙ্গে মাছমারা নিয়ে মাঝেমধ্যে সমস্যা দেখা দেয়।
ভারত উন্নয়নমূলক কাজে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি কেনার জন্য আরও ৫০ কোটি ঋণের ঘোষণাও আছে। ভারত আমাদের যে ঋণ দিচ্ছে কিছু ডিফেন্স মেটেরিয়ালস কেনার জন্য। আমাদের প্রয়োজন অনুসারে যদি কেনা হয় তাহলে ভালো। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ঋণ নিলে হয় কীÑ ওই একই দেশ থেকে কিনতে হবে। অন্য দেশ থেকে কিনতে পারবে না। তারা যে দাম দিবে ওই দামে কিনতে হবে। আরও কষ্টকর ব্যাপার হচ্ছেÑ রিপ্লেসমেন্ট বা নষ্ট হয়ে গেলে আরও চড়া দামে কিনতে হয়। এগুলো তো আর আপনি বাজার দর যাচাই করতে পারছেন না। সুতরাং এগুলো যথাসম্ভব পরিহার করাই ভালো। সে যত কম সুুদেই হোক না কেন।
বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুসারে, আমাদের তালিকায় যা ছিল, আমাদের দাবির মধ্যে যেগুলো ছিল, এগুলোর কোনোটার উল্লেখ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমি বিশেষভাবে দুঃখিত হয়েছি এর মধ্যে তিস্তা চুক্তি নেই এবং অন্যান্য অভিন্ন নদী সেগুলো সম্পর্কে অংশীদারিত্বের কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। ভারত আন্তঃনদী প্রকল্প বলে যে প্রকল্প করতে চাচ্ছে সেটা আমাদের ধারণা মতে, আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সেই সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই এবং তিস্তা নদী সম্পর্কে আমার যেটা মনে হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জী এসে সিভি করে নিলেন যেটা আর কখনো হবে না। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, আপনার (শেখ হাসিনা) এবং আমার সরকারের সময়েই আমরা তিস্তা চুক্তি করতে পারব। কিন্তু তারা যদি না করতে পারেন তাহলে আর কখনোই হবে না। তারা যে করতে পারবেন এ ধরনের অনুষ্ঠান করা কি আর সম্ভব হবে? এখন যেমন তারা তিনজন এক জায়গায় মিললেন। কিন্তু কোনো আলোচনায় হলো না এবং তিনি (মমতা) বললেন, তিস্তাতে কোনো পানি নেই। সুতরাং আমি কী করে পানি দিব! কথা হচ্ছে পানি নেই কেন? পানি নেই এ কারণে যে তারা তিস্তায় কয়েকটি বাঁধ দিয়েছে। তিস্তা নদী তো আছে। নদী তো উৎপত্তি হয়েছে। নদীতে তো বহমান স্রোত আছে। তিস্তার পানিতে তো আমাদের শেয়ার আছে। আন্তর্জাতিক আইনে এটা আমাদের দাবি। আমাদের ন্যায্য হিস্যা।
শুধু তিস্তা নদী নয়, অন্যান্য নদী সম্পর্কেও আমাদের অংশ বা ভাগের হদিস আমরা পাইনি। ভারতের প্রস্তাবিত আন্তঃনদী সংযোগ সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ নেই। সেটা যে আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী সেটা আমরা মনে করি। যে ৬টি চুক্তি সমঝোতা হয়েছে এর থেকে আমরা কোনটাতে উপকার পেলাম, এটা আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। সত্যি বলতে কী বুঝে উঠতে পারলে আমি খুবই আনন্দিত হব। তবে হ্যাঁ বাস, ট্রাক, ট্রেন চালু হয়েছেÑ খুনলা-কলকাতা, সেটা ভালো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে একটির রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। এটার প্রশংসা আমরা করছি। প্রধানমন্ত্রীকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। সেটাও সুন্দর হয়েছে। এসব প্রশংসা যোগ্য। কিন্তু শুধু তিস্তা চুক্তি তো নয়, পানি শেয়ারিংয়েরও ব্যাপারে বড় একটা প্রশ্ন আছে আমাদের। নীতিগত অবস্থান আছে। তিস্তা তো আমাদের মরণ-বাঁচণের প্রশ্ন।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনার আশা করেছিলাম আমরা। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জন্য ভালো, নাকি খারাপ কিছুই হবেÑ এ সম্পর্কে মতামত শেয়ারিং হবে। এমন কিছু তো হতে দেখলাম না। ভারতের অনেকেই বলছেন, রামপাল ভালো কিছু বয়ে আনবে না, এটা খুব খারাপই হবে। সে ব্যাপারে আলোচনা করে তাদের মতামত নেওয়া বা জানা উচিত ছিল। কেনই বা তারা খারাপ বলছেন এবং আমরা কী করতে যাচ্ছি। আমার বক্তব্য হচ্ছেÑ বাংলাদেশের যে প্রাপ্য, যেটা আমরা পাইনি সেটা পানির অধিকার। শুধু তিস্তা নদী নয়, তিস্তাসহ অন্য নদীর অধিকার এবং আমাদের আন্তঃনদী সম্পর্ক যেটা তারা করতে চাচ্ছে সেটার ব্যাখ্যা এবং তা যেন আমাদের জন্য ক্ষতিকারক না হয় সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান। আমাদের বাণিজ্য বণ্টনে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে উল্টো দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের যে ঋণ দেওয়া হবে। সেই ঋণ কী শর্তে দেওয়া হচ্ছে এটা আমরা জানতে চাচ্ছি। প্রথমত, আমাদের যে বর্ডার কিলিংস হচ্ছে। এখনো চলছে। কিছু দিন আগে দেখলাম এক মাস্টারকে ধরে নিয়ে গেছে। বর্ডার কিলিং সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। বর্ডার কিলিং তো বন্ধ হয়নি।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন আমি তার চেষ্টার প্রশংসা করছি। কিন্তু যদি এই সফরে না হয় তাহলে অন্য কি উপায় হতে পারে সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। কারণ প্রধানমন্ত্রী সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছেন, তাদের কনফিডেন্স পাওয়ার জন্যে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, বাংলাদেশ প্রচুর চেষ্টা করেছে, সেটা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। ভারতের আস্থা, বিশ্বাস, তাদের সৌহার্দ্য-প্রীতি ও তাদের বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য। কিন্তু ন্যায্য পাওনা না পেলে তো আমাদের লাভ কিছু হচ্ছে না।
পরিচিতি: ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি
মতামত গ্রহণ: তানভীন আহমেদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান