ময়মনসিংহের কুমির রপ্তানি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে
মাহমুদুল হাসান রতন, ময়মনসিংহ : কুমির চাষে সফলতা এসেছে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে কুমিরের চামরা রপ্তানিও শুরু হয়েছে। তাই এই খাতটিকে ঘিরে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই খাতে বিনিয়োগ করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন বানিজ্যিক খামারের অনুমোদনপ্রক্রিয়া সহজ করা ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা। কুমির চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরাও।
দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমির চাষে অন্যতম ময়মনসিংহের ভালুকার রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ভালুকা উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের হাতিবের গ্রামে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৩ বছর ধরে বাণিজ্যিকভিত্তিতে কুমির চাষ করে আসছে।
২০০৪ সালের ৫ মে খামারটির অনুমোদন দেয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এর পর থেকেই বানিজ্যিক ভিত্তিতে ময়মনসিংহের ভালুকায় শুরু হয় কুমির চাষ। এক কোটি ২৫ লাখ টাকায় আমদানি করা ১৫টি পুরুষ এবং ৬০টি মাদীসহ মোট ৭৫টি কুমির দিয়ে শুরু হয় এর যাত্রা। এরইমধ্যে এখানে বিভিন্ন বয়সের কুমিরের সংখ্যা এখন প্রায় দুই হাজার। স্থানীয় লোকবল দিয়েই চলছে তাদের লালন পালন। কুমিরের খাদ্যের যোগান দিতে ফার্মেই গড়ে তোলা হয়েছে গরু ও মুরগির খামার।
ফার্ম সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এখান থেকে ২০১০ সালে জার্মানিতে ৬৯টি হিমায়িত কুমির রপ্তানির মধ্য দিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পদার্পণ। এরপর ২০১৪ সালে ৪৩০টি, ২০১৫ সালে ৪০০টি এবং ২০১৬ সালে আরো ২০০টি রপ্তানি করা হয়। রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. আবুসায়েম মোহাম্মদ আরিফ বলেন, নতুন করে যারা কুমিরের খামার করতে চান তাদেরকে এখন আর বিদেশ থেকে পরামর্শক বা কুমির আমদানি করতে হবে না। এখান থেকেই যোগান দেয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বছরে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কুমিরের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরিতে সরবরাহ হচ্ছেপ্রায় ছয়শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কুমিরের চামরা ও মাংস। আর তাই খামারের অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা গেলে এই খাত থেকে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা।
ইতোমধ্যে উৎপাদিত কুমিরের চামড়া রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সবমিলিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যে কুমিরের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ভালুকা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে ভরাডোবা-সাগরদিঘি সড়কের উপজেলার উথুরা ইউনিয়নের হাতীবেড় গ্রামে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড কুমির চাষ ও কুমির রপ্তানি করছে।
প্রসঙ্গত, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিগত ২০০৪ সনের ৫ মে খামারটি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিইএস এর অনুমোদন নিয়ে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫টি পুরুষ এবং ৬০টি মাদী কুমির আমদানি করেন। পরে ২২ ডিসেম্বর কুমিরগুলোকে খামারে অবমুক্ত করা হয়। তখন আমদানি করা কুমিরগুলোর বয়স ছিল গড়ে ১০-১৪ বছর। আর কুমিরগুলো লম্বায় ছিল ৭-১২ ফুট। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সনের আগস্ট মাসে ওই খামারের প্রথম দুটি মাদী কুমির ডিম দেয়া শুরু করে। ক্রমান্বয়ে কুমিরের বংশ বিস্তারের মাধ্যমে ওই খামারে প্রায় ৮০০ কুমিরে উন্নীত হয়। সরকারের কাছ থেকে কুমির রপ্তানির চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে ২০০৯ সনের অক্টোবর মাসে জার্মানের হাইডেল বার্ড ইউনিভার্সিটি কুমিরের শরীরের অংশ বিশেষ থেকে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধক মেডিসিন আবিষ্কারের জন্য ওই রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড থেকে কুমির রপ্তানির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ২০১০ সনে ওই খামারের রপ্তানিযোগ্য ৩০০ কুমির মধ্য থেকে ৬৭টি কুমির জার্মানে রপ্তানি করেন। বাকি ২২৩টি কুমির ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিরপ্রক্রিয়া চালান। জার্মানিতে ৭০ লাখ টাকায় ৬৭টি কুমির বিক্রির মধ্যদিয়ে লাভের মুখ দেখে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে কুমির রপ্তানির দেশ হিসেবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নাম লিপিবদ্ধ হয়। কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছর। আমদানিকৃত কুমিরের মধ্যে ১৫টি পুরুষ রয়েছে। প্রতি মাসে এদের ৩০০ কেজি মাংস খাবার হিসেবে দেয়া হতো। বন্য অবস্থায় ১০/১২ বছর বয়সে এবং ফার্মে ৬/৭ বছর বয়সের একটি স্ত্রী কুমির বছরে একবার ৪০ থেকে ৫০টি করে ডিম দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৭০ থেকে ৮০ দিন।
এখানে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে খামারে ৪০টি পুকুর রয়েছে। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার সারওয়াত কুমির ফার্ম থেকে দেড় কোটি টাকার দিয়ে আরও ৪০ টি ব্রিডার কুমির ক্রয় করে আনা হয়েছে। সব মিলে বর্তমানে এ খামারে ৯০টি মা কুমির রয়েছে। এ ছাড়াও এ খামারের নিজস্ব উৎপাদিত ছোট বড় মিলে ১৫ শতাধিক কুমির রয়েছে যে গুলির দৈর্ঘ্য তিন ফুট থেকে সাড়ে ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা।
কুমিরের কোনো কিছুই ‘ফেলনা’ নয় বলে চামড়া, মাংস, দাঁত ও হাঁড় বিপণন করা যায়। চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যমানের কুমিরের গোশতের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ অর্ধশত দেশে কুমিরের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ২০০৪ সালে এটি দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুমিরের প্রজনন শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে তারা কুমিরের চামড়া রপ্তানি শুরু করে। এখন পর্যন্ত মূলত জাপানে বছরে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ চামড়া রপ্তানি হচ্ছে। এর পরিমাণ বাড়িয়ে বছরে দুই হাজার করার লক্ষে কাজ চলছে। সম্পাদনা : মুরাদ হাসান