বৈশাখ ও বাবুর বাংলা না বলা!
অরুণ কুমার বিশ^াস
বেবি আপা অনেকটা শার্টের কলার নাড়ার ঢঙে বলল, এই জানো তো, আমার বেবিটা না বাংলা জানে না! আমার বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাঁত করে উঠল। সে কি! কেন! বস্তুত আমি ধরেই নিয়েছি বেবি আপার বাবুর অটিজম বা বাকপ্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত কোনো প্রবলেম আছে। তাই তার বচন ও ভাষণ সীমিত। কিন্তু আপা সদর্পে কলার নাড়ল যে! তার মানে কাহিনী অন্য। পরে জানা গেল সেই বাবু ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে এবং সে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। তা কেমন সেই ইংরেজি! নাহ্ মোটেও শ্রবণ-সুখকর নয়। চোস্ত ইংলিশ বলতে যা বোঝায় তা তো নয়ই। তাহলে সে কী বলছে! ভাষা বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কি মনের ভাব ঠিকঠাক বোঝানো সম্ভব! বেবি আপা কী বলে শুনুন। তার ধারণা, ভাষা হিসেবে বাংলার দর এখন পড়তির দিকে। দেশে চাকরি-বাকরিও খুব একটা নেই। ছেলে বড় হয়ে ‘আ¤্রকিা বা ইংল্যান্ড’ যাবেই যখন, ইংলিশটা খানিক ঝালিয়ে নেওয়াই ভালো।
তার কথা শুনে হাসব কি কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। সে বোধ হয় জানে না, কবিগুরু রবি ঠাকুরের সেজদাদা বলতেন, আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, তাই বেশ ভালো করেই জানি ইংরেজি শেখার সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের আদৌ কোনো বিরোধ নেই। বরং একটু তলিয়ে দেখবেন, বাংলা ভাষার বড় মাপের যত কবি ও লেখক তাদের অধিকাংশই ইংরেজি সাহিত্য পড়েছেন। কবি শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, কবির চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
সাম্প্রতিক একটি টিভিসি আমার খুব মনে ধরেছে। সেখানে তরুণ প্রজন্মের জনৈক প্রতিভূ চালিয়াতির সুরে বলছে ‘হাগার হাগার লাইকস’, ওরা যেন বাংলা ভুলে গেছে। আমার প্রশ্ন, ভাষার নামে এরা যে সব জগাখিচুড়ি আওড়াচ্ছে এর দায় আসলে কার! আমি কিন্তু মোটেও ইংরেজির বিপক্ষে নই। কারণ বলাই বাহুল্য, ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ বা ভিন্নভাষী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ইংরেজি শেখা আবশ্যক। কিন্তু তাতে মায়ের ভাষা বাংলা শিখতে কার্পণ্যের কোনো কারণ নেই!
অনেকে বলে থাকেন পত্রযোগাযোগের ক্ষেত্রে বানানরীতি অনুসরণের প্রয়োজন নেই, মোদ্দা কথা বা বক্তব্য বোঝাতে পারলেই হয়! আমি এর ঘোর বিরোধী। হালে কিছু কিছু লেখক, যারা কিনা নিজেদের কেউকেটা ভাবেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞতার কারণে গল্প-উপন্যাসে ভুল ও অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। প্রমিত বাংলার ধার ধারেন না। বলতে নেই, এসব ছাইপাশ পড়ে অনেক তরুণ ইদানিং বিপথগামী হচ্ছে।
শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলাটা যে খুব জরুরি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বাচিক উৎকর্ষ। স্যার যখন কথা বলেন আমরা আবিষ্ট হয়ে শুনি। কারণ তিনি বাংলা ভাষার সৌকর্ষকে ধারণ ও স্পর্শ করেন। বাংলাটা তিনি খুব ভালো জানেন। আর জানেন বলেই বাংলাকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছেন।
অথচ বেবি আপারা মনে করে, তাদের বাচ্চাসকল বাংলা ভুলে থেকে ও ভুলভাল ইংলিশ বলে জাতে উঠছে। সবচে বড় কথা, ইংরেজি বা এবম্বিধ অন্যান্য ভাষা জানাটা কিন্তু কোনো জ্ঞানের আকার নয়, ওটা ‘মিডিয়াম অফ কম্যুনিকেশন’ মাত্র। আসছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪। পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমাদের বুকে আবেগের প্লাবন বইছে। বেবি আপার বাবুদের ভালো বাংলাজ্ঞান না থাকলেও পান্তার প্রতি বিশেষ প্রীতি লক্ষ্য করা যায়। বৈশাখের প্রথম প্রহরে মাটির মালসায় করে পান্তার সঙ্গে ইলিশ ভক্ষণ করতে না পারলে কিসের বাঙালি! এরা সব ফোতো কাপ্তানের মতো বাংলাকে বুকে ধারণ না করেও ¯্রফে লোক-দেখানো বাঙালি সেজে বসে আছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় একটাই- পরিবারে ও স্কুলে শুদ্ধ বাংলাচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা। সরকার বাহাদুর চাইলে স্কুলের উপরে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারেন, কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে! বেবি আপাদের বাল্যসুলভ ধ্যান-ধারণা বদলাতে না পারলে আমরা সেই ‘হাগার হাগার লাইকস’-এ আটকে যাব। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির আজন্মলালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান