বাঙালিত্বই রুখবে জঙ্গিবাদ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ইউনেস্কোর নির্বাচিত ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই শোভাযাত্রা। গত বছর (নভেম্বর ৩০, ২০১৬) ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় বিশ্বের ঐতিহ্য রক্ষায় আন্তঃদেশীয় কমিটির একাদশ বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ইউনেস্কো। মঙ্গল শোভাযাত্রা ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটিস’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়ার সময় অবশ্য এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা, পরবর্তীতে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে নাম লাভ করে। ইতোপূর্বে ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ-এর তালিকায় বাংলাদেশের কারুশিল্প জামদানি এবং বাউল গানও স্থান পায়। এছাড়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় বাগেরহাটের ‘ষাট গম্বুজ মসজিদ’, ‘পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ’ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের নাম রয়েছে।
বাংলাদেশের কোনো উৎসবই এত দ্রুত ব্যাপকতা পায়নি, যেমনটি পেয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির নববর্ষ উৎসব এবং তার অন্যতম অনুষঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। মাত্র ১৯৮৯ সালে সূচনাকৃত মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঢাকার চারুকলা থেকে যার সূচনা, সিকি শতাব্দীর মধ্যেই সার্বজনীনতা অর্জন করেছে। এক হিসেবে আন্দাজ করা গেছে গত বছর এ ধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা দশ হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবার সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা আংশিক বাস্তবায়ন হলেও পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। যদিও অনেকে বলেছেন এ ধরনের নির্দেশনার আদৌও প্রয়োজন ছিল না। যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হচ্ছিল এবং দিনদিন ব্যাপকতার দিকে যাচ্ছে তা বাস্তবায়নে সরকারি নির্দেশনা অপ্রয়োজনীয় ছিল। যেমনটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনার তৈরি ও রাতের প্রথম প্রহরে ফুল দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে। সরকারি নির্দেশনায় ও পৃষ্ঠপোষকতার আগেই এদেশে হাজার হাজার শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে এবং বিভিন্ন দিবসে সেখানে পুষ্প অর্পণ করছে সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই। পরিপত্র জারি করে কোনো কাজ শুরু করার ঝুঁকি হচ্ছে পরিপত্র জারি করে তা বন্ধ করা।
বাংলা নববর্ষ আমাদের এখন প্রধান জাতীয় উৎসব, এর ব্যাপকতা দিনদিন বাড়ছেই। আমাদের আবেগ আর ভালোবাসার বাঙালিত্বের এই শ্রেষ্ঠ দিনটিকে এভাবে পেতেও আমাদের কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব-বাংলার বাঙালিকে এই উৎসব পালনে বাধা দেওয়া হতো। বলা হতো, এই উৎসব পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী, আর পাকিস্তান আর ইসলাম ছিল সমার্থক। যা ছিল পাকিস্তানি শাসকদের পছন্দের বাইরে তাই ইসলামি চেতনার পরিপন্থী। উর্দুকে মনে করা হতো পাকিস্তানি অখ-তার বড় রক্ষাকবজ। যার কারণে সমগ্র পাকিস্তানের মাত্র ছয় শতাংশ লোক উর্দুতে কথা বললেও একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। বাংলা মুসলমানের ভাষা হতে পারে না। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে-এ ব্যাপারে যখন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলীম লীগ সদস্য একমত তখন কুমিল্লার কংগ্রেস দলীয় একমাত্র সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের জবাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হলো, ‘হয় বাংলা মুসলমানদের ভাষা নয়, অথবা যারা বাংলায় কথা বলে তারা মুসলমান নয়।’ বাংলা এবং বাঙালির প্রতি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পাকিস্তান নামক বিভ্রান্তিকর রাষ্ট্রটির জন্ম। কাজেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী। তারপরও বাঙালিরা বাংলাকে যেমন ছাড়েনি, তেমনি বাংলা নববর্ষ পালনও বন্ধ করেনি। বরং স্বল্পসংখ্যক বাঙালির শত্রু বাদে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুবির মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন এবং নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম সরকারিভাবে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তবে সে অর্জন স্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলে নববর্ষের সরকারি স্বীকৃতিও রহিত হয়। তবে এতে বাঙালির বাঙালিত্ব বিকাশে এই বাধা প্রবল শক্তি সঞ্চয়ের আঁধার হিসেবে আবির্ভূত হয়। সরকারি বাধার কারণে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ১৯৫৮ সালে বাঙালির নববর্ষের সরকারি ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়। বাঙালিরা সংস্কৃতির উপর এই সন্ত্রাস মেনে নেয়নি। সবচেয়ে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৭ সালে রমনার পাকুড়মূলে (বটমূলে) বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী বর্ষবরণের সূচনা করে। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে শুরু হয় বাঙালির প্রাণের উৎসব এবং কিছুদিনের মধ্যে এ গানটি স্থান করে নেয় বাঙালির সবচেয়ে বেশি গাওয়া জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ এবং একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-এর কাতারে।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। একুশের চেতনার মতো নববর্ষ উদ্যাপনও বাঙালিত্বকে শাণিত করতে ভূমিকা রাখছেÑ এটা পাকিস্তানিরা ভালোভাবে বুঝেছিল। এখনো তাদের ভাবধারার সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সেই একই দৃষ্টিতে বাংলা নববর্ষকে দেখে। পাকিস্তানি ও তাদের এদেশের দোসরদের (আজকের জঙ্গি) বিরোধিতার মধ্য দিয়েই আয়োজন শুরু হয় প্রতিবাদী বৈশাখ উদ্যাপন। বাধা এলে অতিক্রমের প্রয়াশ আরও জোরালো হয়। পহেলা বৈশাখ এখনো আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত টেপা-পুতুল থেকে শুরু করে বাঘ, হাতি, কুমির, পেঁচা, কবুতর, কচ্ছপের বিরোধিতাও কম হয়নি। অনেক প্রতিবন্ধকতা ও সমালোচনা অতিক্রম করেই আজকের সার্বজনীন মঙ্গল শোভাযাত্রা। জঙ্গিদের দোসর মৌলবাদীরা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক বিচারের দেবীর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারী হেফাজতের চৌদ্দ দফা দাবির ১১নং দফাটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা। এমনকি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা বরাবরই চিন্তা-চেতনায় মৌলবাদীদের সমর্থক তাদের অনেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার নতুন রূপটিকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয় বলে বিরোধিতা করে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের বিরোধিতাও নতুন নয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার বন্ধ করলে তার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছিল ১৮ জন বুদ্ধিজীবী। আর পাকিস্তানিদের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিল ৪০ জন বুদ্ধিজীবীÑ এদের মধ্যে শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী অনেকেই ছিলেন। আজকের জঙ্গিদের সংস্কৃতি বলতে কিছু নেই। স্বভাবতই সংস্কৃতিকেই তারা প্রথম গলাটিপে ধরবে। পাকিস্তানি ভাবধারার লোকদের মাতৃভাষার প্রতিই যেখানে শ্রদ্ধা নেই, সেখানে তাদের সংস্কৃতিবোধ আসবে কোত্থেকে। পাকিস্তানি ভাবধারার লোকেরা নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়েই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল, যদিও তখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা মাত্র ছয় শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ২৭.৪৩% ভোটার যারা ছয় দফার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল তারাও ছিল পাকিস্তান ও ইসলামের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বিশ্বাসী, তাদের বংশধররাই আজকের মৌলবাদী যার বড় অংশই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। বাংলা নববর্ষের মতো ধর্মনিরপেক্ষ সার্বজনীন উৎসব বিশ্বে বিরল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসব উপলক্ষে বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ।’ নববর্ষে সবাই মিলে আমরা এত বৃহৎ হব যা দানবীয় জঙ্গি শক্তিকে তাদের ক্ষুদ্রতা বুঝতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে।
বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালিকে ধর্মান্ধ ও জঙ্গিবাদের কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে সকল কূপম-ুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা নিতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে ‘মাছে-ভাতে’ সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, বঞ্চনামুক্ত, বৈষম্যহীন জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান