কওমি শিক্ষার উচ্চ স্তরের স্বীকৃতিতে আলিয়া শিক্ষার সঙ্গে বৈষম্য বাড়াবে
আন্দোলনে নামছে ইসলামি সংগঠনগুলো
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : কওমি মাদ্রাসা সনদ স্বীকৃতির বাস্তবায়ন হলে মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গেও বিষয়টি হবে সাংঘর্ষিক। কারণ সাধারণ নিয়মে মাস্টার্স ভর্তি হওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীর এসএসসি, এইচএসসি এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। আর স্নাতক পর্যন্ত পৌঁছতে একজন শিক্ষার্থীর সময় লাগে ২০ থেকে ২২ বছর।
আর কওমি মাদ্রাসার এই স্বীকৃতিতে কওমিদের নিজস্ব শিক্ষা বোর্ড (দাওরায়ে হাদিসের) পড়া শিক্ষার্থীদের সময় লাগবে মাত্র ১৪ বছর। একইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষার্থীদেরও একই সময় লাগে। বিষয়টিকে সরকারের বৈষম্যমূলক ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দাবি করে এটি প্রত্যাহারের দাবিতে আজ মাঠে নামছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। এদিকে কওমির এই স্বীকৃতির নিয়ে অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় বিষয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডেরই একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। মাস্টার্স ভর্তির আগে এসএসসি-এইচএসসি এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। এখন আবার প্রাথমিকের সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির জন্য জেএসসিও চালু করা হয়েছে। ফলে সরকারি পর্যায়ে সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সবগুলো ধাপই শেষ করে আসতে হয়। এদিকে কওমিদের হলো নিজস্ব বোর্ড, তাদের শিক্ষার্থীরা মাত্র ১৩ বছর পড়ার পরই স্নাতক পাস করে। ফলে সরকারি শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে এসব শিক্ষার্থীদের সময় এবং বয়সে বৈষম্য দেখা দেবে। আর এতে চাকরির বাজারেও তৈরি হবে অস্থিরতা। কারণ কওমির শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স পাস করেই চাকরির জন্য লড়তে পারবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মাস্টার্স ডিগ্রির স্বীকৃতি দিলে এর নিচের স্তরের ডিগ্রিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর জন্য সময় প্রয়োজন। না হয় সাধারণ শিক্ষার্থী ও মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের বয়সের সঙ্গে কওমির মাস্টার্স পাসদের পার্থক্য হবে ৮ থেকে ৯ বছর। আর সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কওমির শিক্ষার্থীরা বেশি সময় পাবে। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, একজন কওমি আলেম মাস্টার্সের সমমান পাবে কিভাবে তা এখনো আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতক ধাপ ঠিক করতে হবে। সবার বেলায় নিচ থেকে শুরু হয় আর কওমিদের ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ওই কমিটির সুপারিশগুলো পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। এই বছরের ১৫ মে থেকে কওমি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা রোববার প্রথম বৈঠক করেছে। তাদের আরও সুপারিশ রয়েছে। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রধান সমন্বয়ক মাওলানা এম এ মতিন বলেন, নতুন স্বীকৃতির ফলে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো ধ্বংস হবে এবং কওমিদের উগ্রশক্তি বাড়বে। এই সিদ্ধান্ত যা সুন্নিয়তের বিরুদ্ধে এবং ওহাবি-সালাফিদের প্রতি অনুগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি জানান, আহলে সুন্নাত নেতারা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংকোচন নীতি ও কওমি শিক্ষা সনদ প্রত্যাহারের দাবিতে ও কাল জেলা-উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং ২০ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী গণভবনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ইন ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যারাবিক এর মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে জানানো হয়, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি (পদাধিকার বলে) আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কমিটি সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল ও সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপকমিটি গঠন করতে পারবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো অবহিত করবে কমিটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা শাখার প্রধান অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেন ভুইয়া বলেন, কওমির এই স্বীকৃতির বিষয়ে এই শাখায় সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা আসেনি। তাছাড়া এটি যেহেতু মাস্টার্স সনদের স্বীকৃতি তাই এ বিষয়টি দেখবে বিশ্ববিদ্যালয় উইং। তিনি বলেন, যেহেতু তাদের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে এবং সেই কমিটি বৈঠক করেছে। আশা করছি মাস্টার্স পরীক্ষার আগের ধাপগুলোর স্বীকৃতির বিষয়েও তাদের সুপারিশ নিশ্চয়ই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-সচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদার বলেন, লিখিত কোনো আদেশ বা অনুশাসন এলে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারব। তারপর প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। এখনো পর্যন্ত এর সমন্বয় নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাইনি আমরা। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত