পহেলা বৈশাখ কীভাবে এল?
রাহাত মিনহাজ
পহেলা বৈশাখ। বাংলার উৎসব। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। হাজার বছর ধরে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ আজকের এই অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কিভাবে এলো এই বৈশাখ? কে শুরু করলেন বাংলা সন গণনা? কিভাবেই বা ঝড়-বৃষ্টি আর প্রকৃতির রুদ্ররূপের বৈশাখ আমাদের সার্বজনীনন আনন্দ-উৎসবের উপলক্ষ্য হয়ে উঠল? প্রিয় পাঠক আপনাদের জন্য এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। নিবন্ধটি সংকলিত।
কিছুটা অস্পষ্টতা আর বিতর্ক থাকলেও সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক বলা হয়। আকবরের শাসন আমলের প্রথম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু সেই দিনপঞ্জিতে ফসল কাটা ও খাজনা আদায়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিনি তার নবরতেœর একজন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সিরাজী ১৫৮৫ সালে বাংলা সৌরবর্ষভিত্তিক একটি দিনপঞ্জি তৈরি করেন। সম্রাট আকবর এই দিনপঞ্জি মেনে নেন এবং তার সিংহাসনের আহরণের দিন অর্থাৎ ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকর করার ফরমান জারি করেন। ফলে বাংলা প্রথম বঙ্গাব্দ হয় খ্রিস্ট্রীয় ১৫৫৬ সাল। ঐতিহাসিকরা আরও উল্লেখ করেন, বিশাল ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের সময়ই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছিল। আর তাই তিনি বিভিন্ন সংস্কার কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন। যার অংশ হিসেবেই আকবর সন বা সাল সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে ভূমি জরিপ শুরু করেছিলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই খাজনা আদায়ে সমস্যার বিষয়টি সামনে চলে আসে। সে সময় খাজনা আদায় করা হতো চন্দ্র সন (হিজরি ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী। আর চন্দ্রসনে প্রতিবছর ১০-১১ দিন পিছিয়ে যেত। তিন বছরে এক মাস পিছিয়ে যেত। আর ৩২-৩৫ বছরে বাড়তি একটি বছর বেড়ে যেত। আর এসব কারণেই সে সময় সারাবিশ্বের প-িতরা হিজরি সনের বিরুদ্ধে তাদের মতামত তুলে ধরনে থাকেন। দিল্লির শাসকরাও এসব কথা জানতেন। এটা পরিবর্তনের পক্ষে তাদের মতও ছিল। যা শুরু করেন সম্রাট আকবর। ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সম্ভবত হিজরি সনের কাঠামো বজায় রেখেই বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তবে মূল পরিবর্তন হয়, চন্দ্র সন থেকে পরিবর্তিত হয়ে বছর গণনা শুরু হয় সূর্য কেন্দ্রিক। খাজনা আদায় আর ফসল ফলানোর সঙ্গে বিষয়টি জড়িত ছিল বলেই সে সময় এই সনকে ফসলী সনও বলা হতো। আর যেহেতু বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সূর্যভিত্তিক মাস গণনা পদ্ধতি অনেক আগে প্রচলিত ছিল সেহেতু এই নতুন পদ্ধতিটি বাঙালিরা সহজে গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে দীর্ঘকাল অতিক্রম করে এই সালটি বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে উৎসবের আবহ তা একদিনে আসেনি। এর সঙ্গে হালখাতা আর পূণ্যহ এর সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই হালখাতা বা পূণ্যহ সব জায়গায় কৃষকদের কাছে খুব একটা আনন্দের উপলক্ষ্য ছিল না। কারণ এ দিন তাদেরকে জমিদার বা মহাজনের পাওয়া পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু তারপরও এই দুই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আনন্দের উপকরণ ছিল। মিষ্টি, মিঠাই খাওয়ানোসহ এই দুই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আনন্দ আয়োজন রাখা হতো। এছাড়া মেলার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। নতুন বছরকে ঘিরে এই মেলার আনুষ্ঠানিকতাও ভিন্ন মাত্রা পায়। আর মুঘল আমলে নওরোজ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হতো। তবে এই উৎসব ছিল শুধু সমাজের উঁচু শ্রেণির জন্য। এ উৎসব ঘিরেই মিনা বাজারের প্রচলন হয়েছিল। রাজপ্রসাদের এই উৎসবে জাঁকজমক থাকলেও এখানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। কৃষক আর জনসাধারণের উৎসব উপলক্ষ্য ছিল মেলা, হালখাতা, পূণ্যহসহ অন্যান্য উৎসব। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পরপরই পাঞ্জাবি প্রশাসন নানাভাবে বাঙালিদের নিগৃহীত করতে থাকে। চালায় উর্দু আগ্রাসন। চেষ্টা চলে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারে। এই সময় বাঙালিরা আরও গভীরভাবে তাদের শিকড়ের টান অনুভব করে। শুরু হয় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সরকারিভাবে প্রথম পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারপর সামরিক শাসন জারিসহ পাক প্রশাসনের আগ্রাসী নীতির কারণে সরকারিভাবে আর পহেলা বৈশাখ পালিত হয়নি।
পহেলা বৈশাখ নিয়ে নতুন করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। ১৯৬১ সালে রবি ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পাক সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এছাড়া পাঞ্জাবিরা ‘হিন্দু’ রবিন্দ্রনাথের গানকে রীতিমতো বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করতে থাকে। এমনই বাস্তবতায় সামনে এগিয়ে আসে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। শুরু হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে পহেলা বৈশাখে গানের অনুষ্ঠান আয়োজন। বৈশাখে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান হয় বলধা গার্ডেনে। এরপর তা স্থানান্তরিত হয় রমনার বটমূলে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুন, কামাল লোহানী, ফরিদা হাসান, আর সবার উপরে ছায়ার মতো ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন কবি বেগম সুফিয়া কামাল । রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রথম বর্ষবরণের গানের অনুষ্ঠান হয় ১৯৬৭ অথবা ১৯৬৮ সালে। সেই সময় অশ্বস্থ (যাকে আমরা বট গাছ বলে থাকি) গাছ থেকে শুয়ো পোকা ঝরে পড়ত। অনেক জঙ্গলে ঘেরা সেই জায়গায় তেমন মানুষ চলাচল করত না। তবে সেই অনুষ্ঠানে ছিল মুক্তভাবে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ। সামরিক শাসকদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে রবিন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার অনাবিল আনন্দ। সেই সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হতো সকাল ছয়টায়। যে ঐতিহ্য আজও বজায় রেখেছে ছায়ানট। সে দিনের সেই শুরু বাঙালি জাতির জীবনে নতুন দিনের সূচনা করে। বর্তমান ছায়ানটের প্রধান আর সেই দিনের সেই শুরু সারথী সানজিদা খাতুন এক নিবন্ধে লিখেছেন, নববর্ষের কান্ত প্রভাত আমাদের মুক্তিকামী করেছিল, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালির রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার পথে।
স্বাধীনতার পর নব উদ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন থেকেই বৈশাখ সরকারি ছুটি। বাঙালির উৎসব আর আনন্দের দিন। তবে এ যাত্রাও খুব সহজ ছিল না। সামরিক শাসক আর নানা সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার ছায়ানটের অনুষ্ঠান আর বৈশাখ আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। মানুষের আবেগ আর ভালোবাসায় পরাজিত হয়েছে অশুভ শক্তি। রক্ষা পেয়েছে সাংস্কৃতিক অধিকার আর স্বাধীনতা। তবে পহেলা বৈশাখ অনেক সময় মানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ৮০ দশকে স্বৈরাচার এরশাদের অপশাসনের প্রতিবাদে চারুকলা থেকে বের করা শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা এখন পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ। যুগে যুগে বৈশাখ উদযাপনের উপর বাধা এসেছে। ১৯৯৯ সালে ঘটেছে বোমা হামলার মতো ঘটনা। কিন্তু তারপরও থেকে থাকেনি এই উৎসব। কোনোভাবেই বন্ধ হয়নি এর বিস্তার। বরং বাঙালির শেকড়ের আর ঐতিহ্যের টানে বৈশাখ পেয়েছে নতুন মাত্রা। পরিণত দেশের বৃহৎ সার্বজনীন উৎসবে।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান