শেখ হাসিনা তৃপ্ত হলেও জনগণ এই সফরে আতঙ্কিত সব চুক্তি নবায়ন হবে : খালেদা
শাহানুজ্জামান টিটু ও কিরণ সেখ: দেশে যদি ফেয়ার নির্বাচন হয় আমরা ক্ষমতায় এলে অবশ্যই দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য যে যে চুক্তি যার সাথে করা প্রয়োজন সেগুলো আমরা রিভিউ করে সেভাবেই আমরা কাজ করবো বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, অবশ্যই দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি হলে তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ভারতের সাথে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেবেন কিনা এবং ক্ষমতায় এলে এসব চুক্তি বা সমঝোতা রিভিউ বা পুনর্মূল্যায়ন করবেন কিনা সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে দেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে গতকাল বুধবার গুলশান নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ব্যর্থ হয়েছে। ভারতকে সবকিছু দিয়ে তিনি খালি হাতে ফিরেছেন। এই সফরে শেখ হাসিনা বলেছেন, এই সফরে তিনি তৃপ্ত। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই সফরের ফলাফলে তৃপ্ত তো নয়ই বরং আতঙ্কিত। তারা জাতীয় স্বার্থবিরোধী একগাদা চুক্তি ও সমঝোতা চায়নি। হিসাবের পাওনা চেয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় ভারতের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ও প্রস্তাবিত বিষয়গুলোতেই কেবল অনেকগুলো চুক্তি ও সমঝোতা সই করা হয়েছে।
পূর্বনির্ধারিত সময় বিকাল সাড়ে ৪টায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করার মতো বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোতে এই সফরে কোনোই অগ্রগতি হয়নি। পরিবেশ বিধ্বংসী রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের স্থান পরিবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী একটি কথাও বলেননি বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ চরম হতাশা ও বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলো যে, নিরাপত্তা সহযোগিতা, অস্ত্র ক্রয়, লাইন অব ক্রেডিট ঋণ, পারমাণবিক প্রকল্পে সহযোগিতা, ডিজেল ও বিদ্যুৎ আমদানি, কানেকটিভিটি বৃদ্ধি, মহাকাশ সহযোগিতা ও সাইবার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যেসব চুক্তি ও সমঝোতায় সই করেছেন তাতে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যই কেবল বাড়বে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভারত হস্তক্ষেপ করেছে এ মন্তব্য করে বিএনপি প্রধান বলেন, দেশের সচেতন নাগরিক ও বিশ্ববাসীর সঙ্গে আপনারাও দেখেছেন যে, সেই কলঙ্কিত ও প্রহসনের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে খুবই ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। ভারতের তদানিন্তন বিদেশ সচিব বাংলাদেশ সফরে এসে ক্ষমতাসীনদের প্রহসনের নির্বাচনের নীল-নকশা বাস্তবায়নে প্রকাশ্যে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কারও অজানা নয়। সে কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, নির্বাচনি প্রহসনের মাধ্যমে ভারতের বিগত সরকারই আওয়ামী বলয়ের শাসন ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা করেছে এবং তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনেই এদেশের জনবিচ্ছিন্ন সরকার ক্ষমতায় টিকে রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতার ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারেনি বা করেনি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, তারা কেবল কৃতজ্ঞতার ঋণই ক্রমাগত শোধ করে চলেছে। এতে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা। খর্ব হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব।
ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই এ মন্তব্য করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগণিত প্রাণদান ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অর্থনীতি, বাণিজ্য, পানিসম্পদ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাবলীর নিরসনের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যাহত করতে ভারতের বিগত শাসকদের একতরফা ভূমিকায় বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করি ভারতের বর্তমান সরকার অতীতের সেই ভুল থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের মনোভাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। গণবিচ্ছিন্ন কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো চুক্তি করা বা চাপিয়ে দেওয়াই বড় কথা নয়। মানুষের সমর্থন ছাড়া কোনো সমঝোতা বা চুক্তিই যে কেবল গায়ের জোরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তার প্রমাণ নিকট ইতিহাসেই রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে সকল আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের অধিকার। এটা কারও কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার বিষয় নয়। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি দুই সার্বভৌম দেশের মধ্যকার বিষয়। এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেই বিষয়টি ফয়সালা করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে দুই দেশের মধ্যেকার আলোচনায় সংশ্লিষ্ট করায় বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত যে এন্টি-ডাম্পিং ক্লজ প্রয়োগ করে থাকে তা তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও এই সফরে প্রধানমন্ত্রী কিছুই করতে পারেননি। সফর শেষে প্রকাশিত দুদেশের যৌথ ইশতেহারে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও এই প্রতিশ্রুতি অতীতের মতোই অন্তসারশূন্য হয়ে থাকবে বলে দেশবাসীর মতো আমাদেরও আশঙ্কা।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, এ ব্যাপারে ভারতের সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনা এখন এই প্রকল্পের উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এখন আরও পিছিয়ে গিয়ে প্রকল্পটির স্থান পরিবর্তন এবং নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভারতীয় প্রস্তাব তিনি মেনে নিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, গতকালের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি দিল্লিতে কিছু চাইতে যাননি। কেবল বন্ধুত্বের জন্য গিয়েছিলেন এবং সেটা তিনি পেয়েছেন। কিসের এই বায়বীয় বন্ধুত্ব তা দেশবাসীই বিচার করে দেখবেন।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতিকে এক্সপ্লয়েট করার জন্য শেখ হাসিনা ভারত সফরের আগে আলেম সম্মেলন করেন। ফিরে এসে গতকালই আবার হেফাজতে ইসলাম প্রভাবিত কওমি মাদ্রাসার ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলেমদের সঙ্গে তার অতীত আচরণ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আঘাতের কথা দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। এখন তিনি নিজেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। অতীতেও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার লক্ষ্যে দেশে ইসলামি শরিয়তি আইন চালুর জন্য একই ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বিদেশিরা এদেশে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চক্রান্ত করেছিল বলে আবারো সম্পূর্ণ অসত্য অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
শেখ হাসিনার অভিযোগের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, সশস্ত্রবাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি কখনো ব্যবহার করেনি। তারাই করেছেন। তারা সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল-এর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। জেনারেল এরশাদ ও মঈনের ক্ষমতা দখল এবং জেনারেল নাসিমের সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় তারাই প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছিলেন। কাজেই নিজেদের অপরাধ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে তারা পার পাবেন না। সম্পাদনা: গিয়াস উদ্দিন আহমেদ