নবীজির হাসি : আহমদ আবদুল্লাহ
একদিন রাসুল (সা.) বাদ ফজর নিজ জায়গায় বসে অনেকক্ষণ মৃদু হাসলেন। এরপর ঘরে গেলেন। আবার এলেন। এভাবে জোহর, আসর, মাগরিব ও এশা পড়লেন। আবার ঘরে এলেন। সাহাবায়ে কেরাম হজরত আবু বকর (রা.) কে বললেন, ‘নবীজিকে একটু জিজ্ঞেস করুন, এমনটি কেনো করলেন তিনি? আগে তো এমন আচরণ করেননি কখনও।’ হজরত আবু বকর (রা.) সবার অনুরোধে রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার থেকে এ ধরণের কার্যকলাপ তো আগে লক্ষ্য করিনি। এর কারণ কি?’ প্রিয় নবী (সা.) বললেন, আমাকে ইহ-পরকালের ভবিষ্যতের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। পরকালে পূর্বাপর সবাইকে এক ময়দানে সমবেত করা হবে। লোকেরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে হজরত আদম (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হবে। তাদের কণ্ঠনালি অবধি ঘামে একাকার হয়ে যাবে। সবাই বলবে, ‘হে আদম! আপনি তো আমাদের পিতা, আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে নির্বাচন করেছেন। তার কাছে আমাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করুন।’ হজরত আদম (আ) বলবেন, ‘তোমরা যে পরিস্থিতির স্বীকার, আমিও সে অবস্থার সম্মুখীন। তোমরা তোমাদের পরবর্তী পিতা হজরত নুহ (আ.) এর কাছে যাও।’ তারা হজরত নূহ (আ.) এর কাছে গিয়ে বলবে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। কেননা রাব্বুল আলামিন আপনাকে বিশেষভাবে মনোনীত করেছেন। আপনার দোয়ায় পৃথিবীতে কোনো কাফেরকে জীবিত রাখেননি।’ হজরত নুহ (আ.) বলবেন, ‘আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং তোমরা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাকে খলিল তথা বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন।’
তখন সবাই হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন, ‘আমার কাছে এর কোনো সমাধান নেই। তোমরা হজরত মুসা ( আ.) এর কাছে যাও। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার সঙ্গে একান্তভাবে কথা বলেছেন।’ কিন্তু হজরত মুসা (আ.) বলবেন, ‘আমার দ্বারা হবে না। তোমরা হজরত ঈসা (আ.) এর কাছে যাও। তিনি তো অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীর আরোগ্য দিতেন। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেন।’ হজরত ঈসা (আ.) বলবেন, ‘আমিও পারবো না। তোমরা বনী আদমের সর্দারের কাছে যাও। পরকালে তিনিই সর্বপ্রথম কবর থেকে বের হচ্ছেন। তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের কাছে তিনিই সুপারিশ করবেন।’ রাসুল (সা.) রওনা হবেন। ঠিক তখন হজরত জিবরাঈল (আ.) রাব্বুল আলামিনের কাছে আসবেন। আল্লাহ তাকে বলবেন, ‘আমার প্রিয় মুহাম্মদকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ এরপর রাসুল (সা.) দীর্ঘক্ষণ সেজদায় পড়ে থাকবেন। রাব্বুল আলামিন বলবেন, ‘হে মুহাম্মদ! বলো, শোনা হবে। সুপারিশ করো, গ্রহণ করা হবে।’ তিনি মাথা তুলবেন। কিন্তু যখন আল্লাহর দিকে তাকাবেন, তখন আবার দীর্ঘক্ষণ সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন।
মহামহিম রব বলবেন, ‘ওঠো! বলো, শোনা হবে; সুপারিশ করো, গ্রহণ করা হবে।’ এরপর তিনি আবার সেজদা করতে যাবেন, তখনই হজরত জিবরাঈল (আ.) তাকে এমন দোয়া শিখিয়ে দেবেন, যা অন্য কাউকে বলা হয়নি। এরপর দয়ার নবী বলবেন, ‘হে আমার রব! আমাকে সবার সর্দার হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এতে আমার কোনো গর্ব নেই। আমায় সর্বপ্রথম কবর থেকে তুলেছেন, তাতেও আমার কোনো অহংকার নেই। এমনকি হাউজে কাউসারের ব্যাপারেও না।’ তারপর বলা হবে, ‘সত্যবাদীদের ডাকো, তারা সুপারিশ করবে। নবীদের ডাকো, তারাও সুপারিশ করবে।’ আম্বিয়ায়ে কেরাম নিজ নিজ উম্মত নিয়ে আসবেন। কোনো নবী পাঁচ-ছয়জন উম্মত নিয়েও হাজির হবেন কেবল। আবার কেউ একাই উপস্থিত হবেন। এরপর ডাকা হবে শহিদদের। তারাও সুপারিশ করবে।’ শহিদরা যখন সুপারিশ করবেন, রাব্বুল আলামিন বলবেন, ‘আমি সব দয়াবানের চেয়ে বড় দয়াবান। যারা আমার সঙ্গে অন্যকে শরিক করেনি, তাদের সবাইকে জান্নাতে প্রবেশ করাও।’ এরপর সদলবলে জান্নাতে প্রবেশ করবে সবাই। আল্লাহ তায়ালা আবার বলবেন, ‘জাহান্নামের ভেতরে ভালোভাবে খুঁজে দেখো, এমন কেউ আছে কিনা, যে কখনও কোনো ভালো কাজ করেছে।’ ফেরেশতারা জাহান্নামে এক ব্যক্তিকে পাবে। রাব্বুল আলামিন বলবেন, ‘তুমি কোনো ভালো কাজ করেছো?’ সে বলবে, ‘জী না। তবে কেনাবেচায় মানুষের প্রতি নমনীয়তা দেখাতাম। ’ আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারাও তার সঙ্গে নমনীয় আচরণ করবেন। এরপর ফেরেশতারা জাহান্নাম থেকে আরেক ব্যক্তিকে বের করে আনবেন। আল্লাহ তায়ালা তাকেও বলবেন, ‘তুমি কখনও কোনো ভালো কাজ করেছো?
’ সেও না-সূচক জবাব দেবে। বলবে, ‘আমি আমার সন্তানদের বলেছি, আমার মৃত্যুর পর মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ছাইগুলি যেনো সমুদ্রের বাতাসে উড়িয়ে দেয়। এতে রাব্বুল আলামিন আমায় কখনও শাস্তি দিতে পারবেন না।’ আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘তুমি এমনটি করেছো কেনো?’
বলবে, ‘আপনার ভয়ে।’ মহামহিম বলবেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ অধিপতির দিকে তাকাও। তোমার জন্য জান্নাতের দশটি রাজ্য নির্ধারিত রয়েছে।’ সে বলবে, ‘আপনি বিশ্ব অধিপতি হয়েও আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?’ এরপর প্রিয় নবী (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-কে বললেন, ‘দুপুরের আগে আমি যে হেসেছিলাম, তার কারণ এটাই।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৪৭৬)। প্রচলিত দলমতের ভিন্নতা ও মতনৈক্য উপেক্ষা করে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক, সাংসারিক প্রতিটা ক্ষেত্র রাসুল (সা.)-এর আদর্শ মোতাবিক হওয়া চাই। তবেই তাঁর উম্মত হিসেবে পরকালে সবার আগে আমরাই নিজেদের মুক্তির জন্য তাঁর বিশেষ সুপারিশের আশা করতে পারি।