রূপের ছটায় উদ্ভাসিত নববর্ষ আজ
ইমরুল শাহেদ: আজ বাংলা ১৪২৪ সনের প্রথম দিন। নানান প্রতিশ্রুতি, আত্মপ্রত্যয়, উদ্দীপনা, আনন্দ-হিল্লোল, উচ্ছ্বাস, আশা-আকাক্সক্ষা আর উষ্ণতায় দেশের মানুষ আবাহন করবে নতুন বছরকে। এদিনে সবার হৃদয়ে রবীন্দ্র-নজরুলের সুর জেগে উঠবে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, কিংবা ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ এদিনটি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় উদ্ভাসিত সর্বজনীন উৎসবের। গোটা দেশ এদিন মেতে উঠে উৎসব আয়োজনে। নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতার মধ্যেও বাঙালিরা বিলীন হয়ে যায় নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্যে। নতুন বছরে গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে উঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ এরপর
খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা-পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। তবে এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। কারণ প্রযুক্তির প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো।বাংলা উইকিপিডিয়া অনুসারে, ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে আজকের পর্যায়ে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশাখের ভিন্ন আমেজের ছোঁয়া লেগেছে ব্যবসায়িক ও সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। ক্রেতা আকর্ষণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ বৈশাখী অফার ঘোষণা করছে। অডিও-ভিডিও কোম্পানিগুলোও বৈশাখ উপলক্ষে নতুন নতুন অ্যালবাম বাজারে ছেড়েছে। ফ্যাশন হাউজগুলোর বিশেষ আয়োজনে নতুন ডিজাইনের পোশাক। নববর্ষের শুভেচ্ছা আদান-প্রদানে কাগুজে কার্ডের চেয়ে ই-মেইল, মোবাইল ফোন এখন অধিকতর কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন আর কেউ হাতের লেখায় জানাতে চায় না যে শুভ নববর্ষ। এখন মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ছোটখাটো এক ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে জানান দেয় শুভ নববর্ষ। আর এই ইন্টারনেটের যুগে এসে অনেকেই ইমেইল করে জানায় শুভ নববর্ষ। আর ইন্টারনেটের বদৌলতে সবাই এখন ফেসবুকের মাধ্যমে জানাচ্ছে নববর্ষের বর্ণিল আমেজে নীল শুভেচ্ছা। সঙ্গে আপলোড করছে মন মাতানো দারুণ দারুণ সব ছবি ও অনুভূতির কাল্পনিক ছবিগুলো প্রকাশ করছে।
বৈশাখকে বরণ করতে সারাদেশ আনন্দে ভাসবে। সবাই একসঙ্গে আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় করবে যেন সেই প্রত্যাশায়- মুছে যাক গেল বছরের যত গ্লানি; যত শূন্যতা, মুছে যাক গেল বছরের যত ব্যথা; যত মর্মকথা, আগামী সাজাও নতুন সাজে; তুমি হও আগামীর আশা, এসো নতুনভাবে শুরু করি… নতুনে শিখি ভালোবাসা।