ইলিশ মুক্ত বৈশাখ : নব আনন্দে, নব জাগরণে
ফাহমিদা হক নতুন বছর শুরু হলো। বাংলা বছর। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এ কথাটি এখন বাংলাদেশে বেশ প্রচলিত। কিন্তু ধর্মীয় উৎসবের সবকিছু কি সবার হতে পারে? প্রত্যেক ধর্মেরই আলাদা আলাদা রীতি-নীতি রয়েছে। কাজেই বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসব হলোÑ বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রাণের উৎসব। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলা একেবারেই উচিত হবে না।
সংস্কৃতি হলো যেকোনো জাতির মানস দর্পণ। যে দর্পণে প্রতিফলিত হয় সেই জাতি বা সামগ্রিকভাবে সেই গণমানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবন ও মূল্যবোধ। মন ও মননে মানুষ যখন সত্যিকারভাবে তার চারপাশের সবকিছুকে ধারণ করে, সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের পথে চলে তখন সে জাতির কল্যাণ সুনিশ্চিত। অর্থাৎ সংস্কৃতি এমন হতে হবে, যার মাধ্যমে জাতি নির্ভেজাল পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং সত্যিকার অর্থে তা হবে কল্যাণের প্রতীক। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হলোÑ বৈশাখের শুরুতে বৈশাখী মেলা। গোটা দেশজুড়ে এই মেলার আয়োজন চলে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন তো বিশ্বজুড়ে খ্যাতি কুঁড়িয়েছে; এর সঙ্গে গত ছ’বছর ধরে চ্যানেল আইÑ সুরের ধারা যৌথভাবে আয়োজন করছে চৈত্র সংক্রান্তি আর হাজার কণ্ঠে বাঙালির বর্ষবরণ। নববর্ষের এই উৎসবকে নবান্নের উৎসবও বলা হয়। এদেশে বাংলা নববর্ষের একটা আলাদা স্বতন্ত্র আবেদন রয়েছে। রয়েছে এর নিজস্বতা। এই একটি মাত্র অনুষ্ঠানে ব্যক্তিসত্তার পাশবিক হুঙ্কার নেই, সংকীর্ণতা বা কোনো মাদকতা নেই, নেই ইতিহাস বিকৃত করে ক্ষমতায় মদমত্তদের বাচালতার কোনো স্থান।
সংস্কৃতি এমন হতে হবে, যার মাধ্যমে জাতি নির্ভেজাল পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং সত্যিকার অর্থে তা হবে কল্যাণের প্রতীক। বাংলা নববর্ষ বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসব কোনো ধর্ম বা গোত্রের একার নয়। বাংলার ঘরে ঘরে কম-বেশি এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব এখন গ্রাম থেকে শহর সবখানে বিস্তৃত। বাংলায় বারোটি মাসের মধ্যে প্রথম বা শুরুর মাস বৈশাখ। তাই এই মাসকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় বৈশাখী মেলা। বৈশাখের প্রচ- উত্তাপে চারদিকের অনাচারকে ঝেঁটিয়ে সাফ করতে, সমাজের সকল বাধাকে অতিক্রম করে সুখের অন্বেষণে নতুন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে বিদ্রোহী চেতনাবোধ জন্ম দেয় এই বৈশাখ। মানবিকতায় মেধা আর মননে মানুষ যখন সত্যিকারভাবে তার চারপাশের সবকিছুকে ধারণ করে সত্য-সুন্দরের পথে চলে তখন সে জাতির উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারে না। পারে না কোনো ক্ষতি করতে।
আবহমানকাল থেকে বৈশাখে মাসব্যাপী নববর্ষের নানা ধরনের উৎসব পালন আমাদের রীতি, রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। পহেলা বৈশাখের দিনে গ্রামের ঘরে ঘরে, যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ ভালো খাবার, ভালো জামা-কাপড়ের আয়োজন করে থাকে, যাতে সারাবছর এই ভালো আর কল্যাণ অব্যাহত থাকে। জনশ্রুতি আছে এ রকম যে, বছরের প্রথম ভালো খেলে, ভালো পড়লে সারাবছর তাই হবে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত বাংলার পহেলা বৈশাখের উৎসব। বাংলা বছরকে সকলেরই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠান মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা দরকার। বিশেষ করে নতুন বছরের প্রথম দিনে আয়োজিত মেলাসহ সকল অনুষ্ঠানই ধর্ম-বর্ণ সকলের কাছে আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতীক।
আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতেই হবে। জাতিসত্তার উৎস সন্ধানে আমাদের ব্যাপৃত হতেই হবে। কারণ এ সত্তার মর্মমূলে লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাণশক্তি। নিজস্ব প্রাণ বন্যায় অভিষিক্ত হতে চাইলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কাছে ফিরে যেতেই হবে। নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে এসে আমরা আত্মপরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠতে পারব না। এ সত্যটি আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা নববর্ষ নিয়ে হীনমন্যতার কোনো অবকাশ নেই।
আমাদের সংস্কৃতির মূল প্রবর্তন ও প্রণোদনা থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই। নিজেদের সংস্কৃতি বর্জন করে ভিনদেশি সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসানোতে অহংকারের কিছু নেই। আবার যদি মনে করি, বাঙালি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি মিশেলে নতুন কোনো সংস্কৃতির সৃষ্টি করে ফেলা যাবে এই বোধটাও বোকার রাজ্যে বসবাসের সামিল হবে। কারণ অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ হয় না, এই কথাটা আমাদের মানতেই হবে।
বাংলা নববর্ষ শত হতাশা, কষ্ট বোধের মাঝেও সকলকে নতুনের আবাহনে উজ্জীবিত করে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়, হালখাতা, বৈশাখী মেলা, নববর্ষের বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন লোকজ অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষকে বাঙালির নিজস্ব উৎসবে পরিণত করেছে। নগর জীবনে অভ্যস্ত মানুষও পান্তাভাত মরিচ দিয়ে খেয়ে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি, বাঙালি ভাব নিয়ে আবির্ভূত হয় এই দিনে। শত আশা-নিরাশার মাঝেও নতুন পুলকে জাগে বাংলার জনগণ। এক বড় বাণিজ্যও গড়ে উঠছে এই উৎসবকে ঘিরে। গণমাধ্যমগুলো সরব হয়ে ওঠে এই দিনে। আর এখানেই জীবন পায় বেঁচে থাকার অন্যরকম আনন্দ। হতাশা ভুলে নতুন জীবনে ফেরার প্রেরণা।
চৈত্র মাসের শেষদিন বা চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রাম বাংলার মানুষ বিভিন্ন শাক ও লতাপাতার কচিপাতা একত্রে রান্না করে খায়। এতে নাকি বিভিন্ন রোগের উপকার ও প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা খাবারের আয়োজনে আকর্ষণ দীর্ঘদিনের পুরনো। অষ্টমী স্নান বাঙালির আরেক উৎসবের দিন। দূর-দূরান্ত হতে হিন্দু নর-নারী এ দিনে ঢাকার লাঙ্গলবন্দ ও ব্রক্ষ্মপুত্রের বিভিন্ন স্থানে স্নান করতে আসে। অষ্টমী স্নান ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামে বহু মেলা বসে। প্রচ- খরতাপে বিরূপ প্রকৃতির মাঝেও এসব মেলায় গ্রাম বাংলায় মানুষের ঢল নামে। এসব মেলায় হরেক রকমের জিনিস পাওয়া যায়। গৃহস্থালি থেকে আসবাবপত্রসহ নানা নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছু মেলায় কেনা-বেচা হয়।
আমাদের দেশে এই বৈশাখী মেলার নামও ভিন্ন হয়, এলাকা ভেদে। যেমনÑ গাজীপুর, কাপাসিয়ায় এই মেলাকে গাছতলা বলা হয়। এ ধরনের মেলায় ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, চরকগাছ ও বিভিন্ন খেলাধুলারও আয়োজন থাকে। মোটকথা, মেলা উপলক্ষে আশেপাশের বাড়ি-ঘরে ঈদের দিনের মতো রান্না-বান্না ও মেহমানের আনাগোনা হয়। হাটে বাজারের দোকানদার ও মহাজনেরা সারাবছরের লাভ-লোকসানের হিসেব মিলিয়ে শুভ নববর্ষের হালখাতার আয়োজন করে।
বৈশাখ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই উৎসব এখন গ্রাম থেকে শহরেও বিস্তার লাভ করেছে ব্যাপকভাবে। দিনে দিনে শহুরে বৈশাখী মেলার প্রচলন ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আর এই মেলার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি । যদিও শহুরে সংস্কৃতিতে যুক্ত হচ্ছে কিছু ভ্রান্ত সংস্কৃতি, যেমন পান্তা ইলিশ। যা আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের নতুন সংযোজন বা নতুন সংস্করণ। যা আগে ছিল না। পান্তা ইলিশকে পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ না করে বরং পান্তার সঙ্গে ভর্তা-ভাজির রেসিপিও যুক্ত করা যায় বাঙালিয়ানার মাধ্যমে। আবার এদিকে গ্রামীণ মেলায় বসে জুয়া, যাত্রার নামে অশ্লীলতা আর নেশার আসর। মোটকথা, এমন কিছু আমরা চাইতে পারি না বা চাইব না যা আমাদের আগামী দিনের জন্য ভালো না। তাই এখন থেকেই মা ইলিশ খাওয়া বন্ধ করে সামনে ইলিশ উৎসবের অপেক্ষা করতে হবে। আবার আমরা হবো মাছে-ভাতে বাঙালি এটা হবে আমাদের ঐহিত্য, গর্ব।
পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনের এক বিশেষ দিন। এই দিনে আমাদের জীবনের এক নতুন বছরের শুরু হয়। পুরনো বছরের যত না পাওয়া, হতাশা দুঃখ আর ক্ষোভ, সব আমরা ভুলে যাই। আর শুরু হয় এক নতুন বছরের, যেই বছরে আমরা নতুন নতুন সব আশা আর স্বপ্নে বুক বাঁধি। আর এমনি সব নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন দিয়েই তো আমরা সাধারণ জনগণ সরকার সবাই মিলে এই প্রিয় জাতি, প্রিয় দেশটাকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের মূল্যবোধ, সত্য সুন্দর আর কল্যাণের উপাসনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সুন্দর আগামীর পথে। নতুন স্বপ্নের দেশ হবে আমার প্রিয় বাংলাদেশ, রুপালি ইলিশের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন/সম্পাদনা: আশিক রহমান