বিশেষ সাক্ষাৎকারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম, খসড়া ঘোষণাপত্রটি অভিজ্ঞ কাউকে দেখিয়ে নেওয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত মিনহাজ
প্রশ্ন: একটা অস্থায়ী বা প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা আপনারা কখন শুরু করেন?
আমীর-উল-ইসলাম: আমি আর তাজ ভাই অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছাই। সেখান থেকে পরদিন আমাদের নেওয়া হয় দিল্লিতে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ১ মার্চে যে দিন গণপরিষদের আহুত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয় সেদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। তাজ ভাই আমার সঙ্গে সবকিছুই আলোচনা করতেন। তিনি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে ও পরে সকল বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। এছাড়া সে সময় আমরা উপলব্ধি করি মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে একটা সাংবিধানিক সরকার গঠন জরুরি। ৭০-৭১ এর নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের বৈধ প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত হবে সেই সরকার।
প্রশ্ন: অস্থায়ী সরকার বাদ দিয়ে অনেকে বিপ্লবী পরিষদ গঠনে তৎপর ছিলেন? বিশেষ করে যুব নেতারা। শোনা যায়, এ নিয়ে দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছিল। আসলে এ নিয়ে কি ঘটেছিল তখন?
আমীর-উল-ইসলাম: বিপ্লবী পরিষদ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন খুবই প্রভাবশালী যুব নেতা ছিলেন। তার এ প্রস্তাবে অনেক সিনিয়র নেতারাও সায় দিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে তাজউদ্দীন সাহেব ও আমি ফিরে আসার পর কলকাতায় উপস্থিত জনপ্রতিনিধি ও যুবনেতাদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। বিপ্লবী পরিষদ গঠন সম্পর্কে আমি যুক্তি সহকারে বলেছিলাম, বাংলাদেশ বারো ভূঁইয়ার দেশ। আজ যদি আমরা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করি, তাহলে এখানে আরও ১১টা বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। ভারতবর্ষসহ বিদেশি রাষ্ট্র বা প্রতিনিধিরা কার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। কিভাবে সাহায্য করবে এর আইনগত ও বাস্তব সমস্যা অনুধাবন করেছিল কি না? আর যেহেতু আমাদের মাঝে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আছে তাতে আমাদের সরকার গঠনের সাংবিধানিক বৈধতা রয়েছে। এছাড়া বহু দেশেই স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে কিন্তু স্বার্থক বিজয়ের দৃষ্টান্ত খুবই কম। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘোষণা ও অভ্যুত্থানকে কিভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। তিব্বত বা কাশ্মীরে যে বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন চলছে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে চে গুয়েভারা শক্তিশালী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর ফলাফল কি? সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি অনুযায়ী আমাদের সরকার গঠনের যে বৈধ অধিকার তা ফেলে দিয়ে অনিশ্চিত ও অমসৃণ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসংকুল পথে পা বাড়ানো সঠিক হবে কি না? আমাদের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্ববাসীর কাছে আইনগত স্বীকৃতি পাবে এবং দেশ ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে। সেই পথে না বিপ্লবের চোরাবালিতে যা কেউ স্বীকৃতি দেবে না? আমার এ বক্তব্যে কাজ হলো। সমস্ত হাউস স্তব্ধ। পরে সবাই সম্মিলিতভাবে এ যুক্তি মেনে নেয়।
প্রশ্ন: মুজিবনগর সরকারের শপথের আগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। যা এখন আমাদের পবিত্র সংবিধানের অংশ। আমরা যতদূর জানি, আপনি এ ঘোষণাপত্র রচনা করেন। বিষয়টি যদি একটু বলতেন।
আমীর-উল-ইসলাম: আমাদের হাতে সময় ছিল কম। ঘটনা অনেক দ্রুত ঘটছিল। একদিকে নেতাদের একত্রিত করতে কলকাতা ও আগরতলায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ সভার মাধ্যমে ঐকমত্য সৃষ্টির কাজ এবং মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান; অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরের অবস্থাও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। সে সময় আমাদের সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সীমিত অস্ত্র নিয়ে তা দিয়ে তারা আর এভাবে পারছে না। তাদের আমরা ৎবঃৎবধঃ, ৎবঢ়ড়ৎঃরহম, ৎবমৎড়হঢ়রহম এর নির্দেশ পাঠিয়েছি। এসব নিয়ে আমরা খুবই ব্যস্ত। ভারতের মাটিতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ঃৎধরহরহম, ৎবমৎড়ঁঢ়রহম এ সবগুলো খুবই জরুরি ভিত্তিতে করতে হচ্ছে। কলকতায় আমি আর তাজ ভাই যে কক্ষে থাকতাম তার কোণায় একটা ছোট্ট টেবিল ছিল। সেখানে লোখালেখির কাজ করতাম। আমার সঙ্গে কোনো বই বা ডকুমেন্ট ছিল না। আমাদের একটি সাংবিধানিক দলিল প্রয়োজনÑ যেটা শপথ অনুষ্ঠানেও পাঠ করা দরকার। তাছাড়া আমাদের যুদ্ধ ও সরকার গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে একটা সাংবিধানিক দলিল প্রয়োজন। তিনি একমত হলেন। এরপরই আমি ঘোষণাপত্র লেখার কাজ শুরু করি। সেই সঙ্গে আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য খধংি ঈড়হঃরহঁধহপব ধহফ ঊহভড়ৎপবসবহঃ ড়ৎফবৎ তাকে দেখালে তিনি অনুমোদন করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যদের দেখালাম। তারাও এক কথায় বললেন ঠিক আছে, ভালো হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা বা কেউ এটাকে পৎরঃরপধষষু দেখলেন না বা আলোচনা করলেন না। আমি কিছুতেই স্থির হতে পারছিলাম না। ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম, খসড়া ঘোষণাপত্রটি অভিজ্ঞ কাউকে দেখিয়ে নেওয়ার। আমি বিএসএফ-এর মি. চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কলকাতায় কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক আইনে পারদর্শী কোনো আইনজীবীকে জানেন কি না। তিনি একজনের নাম সংগ্রহ করে দিলেন। সুব্রত রায় চৌধুরী। আমি তাকে ফোন করে একটা ধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ করে নিলাম। বালিগঞ্জের বাসাতেই তার চেম্বার। সাক্ষাতে পরিচয় দিয়ে বললাম যে, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেছি। যুদ্ধাবস্থায় নানা কাজের মাঝে ব্যস্ত অবস্থায় তৈরি করেছি। কিন্তু একজন ঢ়ৎড়ভবংংরড়হধষ কাউকে না দেখালে আমি স্বস্তি অনুভব করছি না। এ অবস্থায় আপনি আমার ফড়পঁসবহঃটি অনুগ্রহ করে পড়ে এটাকে ংবঃঃষব করে দিলে বাধিত হব। তিনি আমার হাত থেকে ওটা নিয়ে পুরোটা পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালেন আর বললেন, একটা দাড়ি, কমা, সেমিকোলন কিছুই বদলানোর প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার যুক্তি ও প্রেক্ষিত জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। মানবাধিকার আইনে আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকৃত।
প্রশ্ন: শপথ অনুষ্ঠানের স্থান কিভাবে নির্ধারিত হলো?
আমীর-উল-ইসলাম: প্রথমে কুষ্টিয়ার আরেক সীমান্তবর্তী মহকুমা চুয়াডাঙ্গায় ১৪ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী সেখানে আকাশ থেকে হামলা চালায়। তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি তখন বলি পাকিস্তান বিমান হামলার ঝুঁকি মাথায় রেখে আমাদের এমন একটি জায়গা বেছে নিতে হবে যেখানে ভারতের ধরৎ পড়াবৎ পেতে পারি। আমি তাজ ভাইকে বলি সাংগঠনিক কাজে আমি মেহেরপুরের ভবেরপাড়ায় একটি মিশনারি স্কুলের অবস্থান জানি। তার কাছেই একটি বিরাট আম বাগান। সেখানে শপথ অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। বিএসএফ-এর কাছে ওই এলাকার একটা ম্যাপ পাওয়া গেল। সেই ম্যাপে ওই আম বাগান ও মিশন স্কুলের উল্লেখ আছে। গোলক মজুমদার নিশ্চিত করলেন যে, ধরৎ ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ তারা দিতে পারবেন। ভারতের মাটিতে ধহঃর ধরৎ পৎধভঃ মঁহ বসানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই জায়গাটা এমন একটা বহপষধাব যে তার তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত, ওখানে ধরৎ ংঃৎরভব করতে গেলে ভারতের ধরৎ ংঢ়ধপব-এ ঢুকে পড়তে হবে। ফলে জায়গাটি আমাদের জন্য খুবই নিরাপদ।
প্রশ্ন: এ শপথ অনুষ্ঠান সফল করতে আপনাদের প্রস্তুতি কেমন ছিল?
আমীর-উল-ইসলাম: তখন কাজের চাপ আর উত্তেজনায় রাত আর দিন সবটাই কাজের সময়। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হচ্ছিল। প্রতিটি বিষয় খুটি-নাটি সবই দৃষ্টিতে রাখতে হচ্ছে। ১৭ এপ্রিল দুটি ভাগে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিকদের বৈদ্যনাথতালায় পাঠানো হয়। ১৬ এপ্রিল জনাব আব্দুল মান্নান এম.পি. ও আমি কলকাতা প্রেসক্লাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথম চৎবংং নৎরবভরহম করি। এটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম চৎবংং নৎরবভরহম. আমরা বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে তাদের শুধু বললাম, আগামীকাল সকাল সাতটাই তারা এখানে উপস্থিত হলে আমরা তাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের একটা মেসেজ পৌঁছে দিতে পারব। পরদিন সকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আমন্ত্রণ জানাই। ঠিক সময়মতো তারা উপস্থিত হলেন। উপস্থিত ছিল একশত ট্যাক্সি। ট্যাক্সিচালক আর বিএসএফের লোক। রাতে এমনভাবেই রওয়ানা হন মন্ত্রিসভার সদস্যসহ কলকাতায় উপস্থিত সকল জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ।
প্রশ্ন: আপনারা কখন বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছালেন? কখন অনুষ্ঠান শুরু হলো? কতক্ষণ স্থায়ী ছিল অনুষ্ঠানটি?
আমীর-উল-ইসলাম: সাংবাদিকদের নিয়ে আমরা বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছায় বেলা দশটার দিকে। অনুষ্ঠান শুরু হয় এগারোটার দিকে। প্রথমেই গাওয়া হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি আবেগময় বক্তব্য রাখেন। তাতে তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ইংরেজিতে একটা লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এ বক্তব্যটা আমরা দিল্লিতেই তৈরি করি। একদল সৈনিক ‘গার্ড অব অনার’ দেয় নবগঠিত মন্ত্রিসভাকে। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
সরহযধুথঁফফরহথফঁ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান