‘নিজে কানা পথ চিনে না, পরকে ডাকে বারংবার’
‘মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কী করে চিনবে বলো’ এটা শুধু পুরানো বাংলা ছবির গানের প্রশ্নও নয়, বর্তমান সময়ের প্রাণের প্রশ্নও। পুরানো দিনের আরেক বাংলা ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’। সেই ‘মুখ ও মুখোশে’র বৈপরীত্য এখনকার দিনে আরও জটিলতর হয়েছে। মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ছে সত্যিকার মুখ, মানুষ। মুখোশ থেকে মুখ আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ বাঁচতে হলে, বাঁচাতে হলে এই মুখোশগুলো সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরানোর মানুষ কই। মুখোশহীন মুখ কই, মানুষ কই, যারা সরিয়ে দেবে অন্ধত্ব আর অহংকারের চেপে বসা মুখোশ। গিট্টুটা এ জায়গাতেই!
পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় এবার মুখোশ নিষিদ্ধ ছিল। ঢাকার পুলিশ কমিশনার মুখোশ, ব্যাগসহ কিছু জিনিস বহনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। কারণটা হলো নিরাপত্তার। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আহাজারির শেষ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কেন এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, কেন সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে ভুলুণ্ঠিত করা হলো, এমন নানা রংয়ের আহাজারি। আর আহাজারির এ আফসোস স্বভাবতই বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। একজনের আহাজারি দেখলাম অনেকটা এ রকম, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশের প্রয়োজন কী, সব মুখোশ তো পড়ে আছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা’। আহাজারির বক্তব্যের পুরোটাই মিথ্যে নয়। তবে সেটা অন্য সময়ের কথা। আগে মুখোশ না পরার আদেশ বা অনুরোধটার কথা বলি।
সারাদেশে একটি বিপর্যস্ত অবস্থা চলছে। এটা কেউ মুখে অস্বীকার করলেও চোখে তা দৃশ্যমান। এখন মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। এই শংকারই সংগত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মুখোশ না পরার কথায়। এ সময়ে কথিত সংস্কৃতির বাহুল্য উদযাপনের চেয়ে মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই প্রধান। সুতরাং এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার পশ্চাতে শক্ত কোনো লজিক থাকার কথা নয়। কিন্তু লজিকের ধার ধারে কে! লালন বলেছেন, ‘প-িত কানা অহংকারে, সাধু কানা অনবিচারে… এসব দেখি কানার হাট-বাজার’। আমাদের যারা প-িত ব্যক্তি তারা অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধ হয়ে যান এবং সেটা অবশ্যই অহংকারে। ফলে আশেপাশে কি ঘটছে সে সম্পর্কে তারা থাকেন নিরাসক্ত, যেন কোনো কিছুতেই যায় আসে না। একা নিরাসক্ত থাকলে অসুবিধা ছিল না, কিন্তু যখন অন্যের আসক্তিও কাটাতে যান, ঝামেলাটা বাধে সেখানেই। নিরাপত্তার কথা গেল, এবার আসি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। ‘শোভাযাত্রা’ যদি উৎসবের অনুষঙ্গ হয় কোনো অসুবিধা নেই, সেটা যে নামেই হোক। অনেকে বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিন্দুদের উৎসব। একটি দিনকে উপলক্ষ্য করে কেউ যদি আনন্দ করতে চান, শোভাযাত্রা করতে চান তাহলে সেটা কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা কারও উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে কেন। পুরানো ঢাকায় মুসলিমদের ঈদ মিছিল হয়, হিন্দুদের বিজয়া শোভাযাত্রা হয় এসবকে সহজেই চিহ্নিত করা যায় ধর্মীয় উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে। কারণ এসব উৎসবের নামকরণ, সাজ-পোশাক, আচার-উপকরণ সবই একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের পরিচয় বহন করে। কিন্তু বাংলা বছরের প্রথম দিনে যে আনন্দ শোভাযাত্রা হয় সেটা ‘মঙ্গল’ বা যে নামেই হোক তাতে তো কোনো ধর্মীয় সাজ-পোশাক, আচার-উপকরণ বা পরিচিতি থাকার কথা নয়। আর না থাকলে বছরের প্রথম দিনের এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে কেন বিশেষ একটি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের বলে চিহ্নিত করা হবে!
যারা এমন একটি উৎসবকে ধর্মীয় পরিচয়ে গ-িবদ্ধ করতে চান তারা নিশ্চিত অন্যায় করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এক হাতে কী তালি বাজে? ঈদ মিছিলের কিছু দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা উৎসবের অনুষঙ্গটিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট করেছে। বিজয়া শোভাযাত্রার তেমনি দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটির ধর্মীয় পরিচিতি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে এমন হবার তো কথা নয়। সার্বজনীনতার প্রশ্নে এমন দৃশ্যমান প্রচেষ্টা সত্যিকার অর্থেই অন্যায়। যারা না বুঝে একে ‘হিন্দুদের উৎসব’ বলেন তারা অন্যায় করেন। কিন্তু যারা বুঝেও দৃশ্যমান প্রতিকে ‘সার্বজনীন’তাকে নষ্ট করতে চান তারা আরও বড় অন্যায় করেন। ‘সাধু কানা অনবিচারে’ এজন্যই বলেছেন লালন সাই।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ইউনেস্কো ‘ইনট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমিনিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কেন করেছে তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে’র ভাষাতেই বলি, ‘ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় ইউনেস্কো কমিটি’। অর্থাৎ আমাদের প-িতদের ভাষায় যা ‘সার্বজনীন’, সে কারণেই তালিকাভুক্ত হয়েছে এই উৎসবানুষঙ্গটি। কিন্তু এই ‘সার্বজনীন’ বিষয়টি ‘জনীন’ হিসেবে বিতর্কিত হচ্ছে কেন? কেন দেশের অধিক মানুষের ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করে তাদের অংশগ্রহণকে সংশয়িত করা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই লালনের ভাষায় ‘অহংকারে অন্ধ প-িতে’রা সংস্কৃতির দোহাই পারবেন, বলবেন ‘ইহাই আমাদিগের বঙ্গ বা বাঙালি সংস্কৃতি। ইহাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া আমাদিগকে লতার মতোন অন্যার্থে পরগাছার মতোন বাঁচিয়া থাকিতে হইবে।’ আবার লালনের কথা বলি, ‘নিজে কানা পথ চিনে না, পরকে ডাকে বারংবার’! আরে ভাই আপনার এই ‘অনবিচারে’ তো শোভাযাত্রা কেন বাংলা নববর্ষটাই ছুঁড়ে ফেলতে হয়। কারণ এই নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতার শুরু যিনি করেছিলেন তিনি বাঙালি ছিলেন না, হিন্দুও ছিলেন না। মুসলিম সম্রাট আকবরের ছোঁয়া লাগা এমন বর্ষকে বরণ করা তো দূরের কথা, হিসাবমতো ‘অস্পৃশ্য’ বলে ঝেটিয়ে বিদায় করা উচিত। পহেলা বৈশাখকে আপনারা যে উৎসবের ধাঁচের সঙ্গে মিলিয়ে তালেগোলে এক করে ফেলেন তা সম্ভবত ‘চৈত্রসংক্রান্তি’। যা ‘কাল’ বা সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং যা ‘সনাতনী’দের ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ। আর ‘পহেলা বৈশাখ’ ছিল রাজা, জমিদারদের খাজনা আদায়ের ভীতিকর শুরুর দিন। সে অবশ্য অনেক কথা, আরেকদিন অন্য কোনো লেখায় তা আলোচনা করা যাবে। আপাতত মঙ্গল শোভাযাত্রা বিষয়েই বলি।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় যারা পেঁচা, বাঁদরের মুখোশ নিয়ে কিংবা প্রতিকৃতি নিয়ে যান তাদের যদি বলি, এই প্রতিকৃতি কিসের প্রতীক! শোভাযাত্রা বলেন, উৎসব বলেন, অনুষ্ঠান বলেন সবের পেছনেই কিন্তু ঈশপের কল্পগল্পের মতোন একটি ‘মেসেজ’ থাকে! পেঁচা, বাঁদর বা বিতর্কিত কোনো প্রতিকৃতি যা কোনো ধর্মীয় প্রতীকের সাদৃশ্যমান তা কিসের ‘মেসেজ’ বহন করে? পেঁচা আমাদের কাছে অশুভের প্রতিক। পেঁচার ডাক এ বাংলায় চিরকাল অমঙ্গলকর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাঁদর আমাদের কাছে বাঁদরামোরই প্রতীক। ময়ূর আমাদের সার্বজনীনতার অংশ নয়। কী প্রয়োজন এমন প্রতিকৃতির! হয়তো সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন বলবেন ‘ইহাই সংস্কৃতি’। তাহলে মহরমের তাজিয়া মিছিলের প্রতীকী ভার্সন যোগ করেন, ঈদ মিছিলের প্রতীকী ক্যানভাস যুক্ত করেন, এসব তো আমাদের সংস্কৃতির বাইরে নয়। এগুলো যদি শোভাযাত্রাকে বিতর্কিত করে, তাহলে লক্ষীর বাহন পেঁচা, কার্তিকের ময়ূরও করে, সঙ্গে অন্যসব প্রতিকৃতিও তার বাইরে নয়। এ সহজ সত্যটা মানতে বাধা কোথায়! না কী কাহিনী অন্যখানে, লালনের ভাষাতেই বলি, ‘কানায় কানায় উলামিলা, বোবাতে খায় রসগোল্লা’।
‘বোবাতে রসগোল্লা’ খাবার কারণেই আজ ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে, বিতর্কিত হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। উচ্চারিত হয় মাত্র চল্লিশ বছরের পুরানো একটি ‘শোভাযাত্রা’ যদি ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত হয় তাহলে চার’শ বছরের পুরানো ঢাকার ঈদ মিছিল নয় কেন। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে যে উৎসব অনুষঙ্গের উৎপত্তি, তা তো দেশব্যাপীও ছিল না। শুধুমাত্র এবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলেই সারাদেশে বের হয়েছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আর তা সরকারি উদ্যোগে, উৎসাহেই। মূলত আশির দশকের আগে এই শোভাযাত্রা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ বা ‘বৈশাখ’ বিষয়ক কোনো উৎসবেরই অনুষঙ্গ ছিল না। তারপরেও আমাদের উৎসব প্রবণ মানুষেরা এটিকে উৎসবের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন এবং তা ‘সার্বজনীন’ অর্থেই। কিন্তু ‘কেলো’ করলেন লালনের ‘প-িত কানা অহংকারে, সাধু কানা অনবিচারে’র প-িত আর সাধুরা।
শুরু করেছিলাম ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে, মুখোশের আড়ালে মানুষকে না চেনার সংশয় নিয়ে। আর শেষ করছি ‘অহংকার’ ও ‘অনবিচারে’র মুখোশ আটা প-িত আর সাধুদের প্রতি লালনের চরণ উৎসর্গ করেÑ
‘এক কানা কয় আর এক কানা রে
চল এবার ভবপারে
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বারংবার।
এসব দেখি কানার হাট বাজার।’
সম্পাদনা: আশিক রহমান