আত্ম-বন্দিত্ব থেকে মুক্তির সেই দিন
বাহালুল মজনুন চুন্নূ
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার দিবসের মাহাত্ম্য বাঙালি জাতির জীবনে অনির্বাণ শিখার মতো সবর্দা বহমান থাকবে। এই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, ইচ্ছা বুকে ধারণই নয়, তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। দক্ষ নেতৃত্বগুণেই মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনি কণ্ঠে তুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হানাদার বধে আর ছিনিয়ে এনেছেন লাল-সবুজ পতাকা। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়ে বুঝেছিলেন প্রতিষ্ঠিত কোনো সরকার ব্যতীত আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের জন্য কেবল সহানুভূতি ও সমবেদনাই তিনি পেতে পারেন। অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করলেন। কিছু বিরোধিতার মুখোমুখি হলেও তিনি সকল বাধা অতিক্রম করে ১০ এপ্রিল ঘোষণা করেন অস্থায়ী সরকার। সেই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং বাংলাদেশের অখ-তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। এই সরকারের মূলভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন যেখানে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল এবং এই নির্বাচনকে ভিত্তি ধরার মধ্য দিয়ে এই অস্থায়ী সরকার গণতান্ত্রিক রূপ লাভ করেছিল।
১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খবরটি যেকোনোভাবে হোক পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। তারা ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়। এরপর খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে মেহেরপুরকে শপথ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশ্বস্ত কয়েকজন। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতই কঠিন গোপনীয়তা অবলম্ব^ন করেছেন যে, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, কলকাতা থেকে শতশত মাইল দূরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে; ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার এক আম্রকাননে বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারো উদিত হতে যাচ্ছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপোর্টে গোপনে সজ্জিত হয়েছিল ভারতীয় যুদ্ধবিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূ-খ-ে অবস্থান করছিল ভারতের সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিল। আম্রবাগানের চারিদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
গুরুত্বপূর্ণ এই শপথ অনুষ্ঠানের আগের রাতের মুষলধারে বৃষ্টি যেন সেই আম্রকুঞ্জে শুভ্র পবিত্র আবহ তৈরি করে ওই দিনটির মাহাত্ম্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আকাশে মেঘের সঙ্গে আলোর অবিরাম লুকোচুরি খেলা চলছিল। বৈশাখের সোনালি রোদ আর আম্রকুঞ্জের দূরন্ত বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে আগত মানুষজন যেন দীর্ঘ আকাক্সিক্ষত বিজয়সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছিল। কাভার করার জন্য দেশি-বিদেশি প্রায় জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। শতশত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগন বিদারী সেøাগানে সেøাগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। খোলা আকাশে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের সামনে বাঁশের মাঝামাঝি বাঁধা কালোরাতের বিভীষিকার রক্তে রঞ্জিত, অকুতোভয় বাঙালির শৌর্য থেকে উৎসারিত স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা। বেলা এগারোটায় শুরু হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান। মাইকে অনুষ্ঠানের ঘোষণা করছিলেন আব্দুল মান্নান। শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হলো। চারশ চৌষট্টি শব্দে রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূলভিত্তি। প্রজাতন্ত্রের সূচনালগ্নে এই ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক বৈধতার শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা গৌরব বহন করে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের প্রেক্ষাপট, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন-বঞ্চনা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব অভিব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’Ñ এই তিনটি বিশেষ শব্দ চয়ন করা হয় যা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চিত হয়ে এসেছে কয়েক সহস্র বছর ধরে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই ঘোষণাপত্র তথা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এখানে সাম্য বলতে সকল নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার থাকার কথা বোঝানোর মাধ্যেমে ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছে। মানবিক মর্যাদার উল্লেখের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকার কথা বলা হয়েছে এবং সামাজিক সুবিচার বলতে সকল প্রকার আর্থসামাজিক শোষণমুক্ত সমাজকে বোঝানো হয়েছে।
ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর মঞ্চে ধীর পায়ে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কর্নেল ওসমানী। উচ্চারিত হলো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে শপথবাক্য পাঠ করানো হলে মুহুর্মুহু করতালি আর সেøাগান, ফ্লাশলাইটের ঝলসানো আলোই প্রমাণ করে দিচ্ছিল বাঙালির জীবনে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে, যে সূর্যের আলোয় মাখামাখি হয়ে বাঙালি গেয়ে যাবে নবজীবনের গান। এরপর এদেরকে গার্ড অব অনার দেন তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর তার কন্টিনজেন্ট নিয়ে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা থাকলেও দেরি হয়ে যাচ্ছিল বিধায় তৎকালীন এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহীর পরামর্শে মাহবুব উদ্দিন কয়েকজন সৈনিক ও আনসারদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন। জাতীয় সংগীত গাওয়া হলো। মানচিত্র খোচিত স্বাধীন দেশের পতাকা উড্ডয়ন করা হলো। সবার চোখেই খেলা করছিল পরাধীনতার তমসা হরণের বিস্মিত জ্যোতি যা আম্রকুঞ্জের পত্রপলবের ফাঁক দিয়ে বিচ্ছুরিত সোনালি সূর্যের ঋজু রশ্মির সঙ্গে মিশে এক অনবদ্য ঐক্যবদ্ধ শক্তির ইন্দ্রজালের প্রতিচ্ছবি এঁকে দিয়ে জানান দিচ্ছিল বীর বাঙালি পাকিস্তানকে বিদীর্ণ করে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জš§ দিতে পেরেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সেদিনের ভাষণে দীপ্তকণ্ঠে পাকিস্তানি জান্তা ইয়াহিয়াকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানি মিলিটারিা যারা রক্ত ঝরাচ্ছে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে না। আমাদের ছেলেরা ধ্বংস করে দেবে। এই যুদ্ধে জয় আমাদের অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ন করবই। আজ না জিতি, কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হলো তা চিরদিন থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে। পাকিস্তান কবরস্থ হয়েছে লাখো বাঙালির মৃতদেহের স্তূপে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।’ তাদের সেই দিনের ভাষণ সারা বিশ্ববাসীর কাছে সেই বার্তাই বইয়ে দিয়েছিল যে, বাঙালি তাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে শুধু প্রস্তুতই নয়, দেশ মাতৃকার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। প্রকৃতপক্ষে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাঙালিদের আত্ম-বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছিল। আর মুজিবনগর সরকার হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান