নো ঝামেলা উইথ আল্লামা সাহেব, বরং গুড বাই টু নাস্তিক বাহিনী। ক্লিয়ার?
সা? বেশ মজাতেই কাটছে সময়টা, তাই না? চারিদিকে কেবল বিনোদন। আমারও খারাপ কাটল না। একদিকে শাকিব-অপু, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন। সঙ্গে বোনাস হিসেবে আল্লামা শফি সাহেবের সঙ্গে আলাপচারিতা। আর উপরি পাওনা হিসেবে সবকিছু ছাড়িয়ে আনন্দ বন্যা বইয়ে দিয়েছে ফেসবুক। বিলিভ মি, ঘটনা যত না বিনোদন দিচ্ছে, তা নিয়ে জনতার প্রতিক্রিয়া আনন্দ দিচ্ছে তিনগুন।
প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাওয়ার আগে ছিল মূলত দুটো ঘটনা। এক মাশরাফির অবসর আর প্রতিরক্ষা চুক্তি। অবসর কেন, কে দায়ী তা নিয়ে বাঙালি যথারীতি দুদিনের জন্য শার্লক হোমস হয়ে উঠেছিল। যুক্তিতর্কের টোপলা সাজিয়ে প্রমাণ করে দিল, আসল নাটের গুরু হাতুরুসিংহে। শাস্তিও ঘোষণা হয়ে গেল, এই ব্যাটাকে অচিরেই ঘাড় ধাক্কা দেওয়া উচিত। ‘আর খেলাই দেখব না’ মার্কা স্ট্যাটাসও যেমন পড়ল, তেমন অশ্রুসিক্ত বিদায় জানাল কেউ কেউ। কেউ জানাল ভালোই করেছে, সম্মান নিয়ে গেল। বাঙালি যেহেতু কোনো টপিকে বেশিদিন স্থির থাকে না, তাই আপাতত আবেগে ব্রেক লেগেছে। তবে পরের ম্যাচে হারলে যথারীতি হাতুরুসিংহের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে সময় নষ্ট করবে না। আবার জিতলেও আহ্লাদ দেখাতে পিছপা হবে না। সো, এটা টপিক হলেও, তেমন টপিক না। এসব কানে না দিলেও চলবে।
প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরেও কারও তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। যা ছিল তা ছিল প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কি না তা নিয়ে। ধারণা করা হয়, চীন থেকে সাবমেরিন কেনায় ভারত কিঞ্চিত মনঃক্ষুণœ হয়েছে। তাই তারা চাইছিল, এরপর থেকে যেন সব অস্ত্রপাতি ভারত থেকেই কেনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সম্ভবত এই প্রস্তাবে সায় ছিল না। তাই বার কয়েক সফর পিছিয়েছিলেন। তাকে রাজি করাতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ঢাকা সফর করে যান। অবশেষে, এই সফর। তিস্তা চুক্তি যে হবে না, জানাই ছিল। দেখার ব্যাপার ছিল, প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষর আটকাতে পারেন কি না। সেটা পেরেছেন। চুক্তি যে হচ্ছে না, ব্যাপারটা বিএনপির থিংক ট্যাঙ্ক জানতো কি না জানি না, তবে তারা যথারীতি তার সফরের আগে থেকেই ‘দেশ বিক্রি’ নিয়ে হাউকাউ শুরু করে দিয়েছিল। অনেকটা সেই হাউকাউয়ের জবাব দিতেই আয়োজন করা হয় এই সংবাদ সম্মেলনের। খুব আলোচিত কোন টপিক না, বিশেষ করে আমাদের রাজনীতিতে ভারত আর পাকিস্তানের দালাল বলে ডাকা তেমন কোনো ব্যাপার না, হর হামেশাই হচ্ছে।
যাই হোক, সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক ভাইয়েরা যথারীতি তাদের পেশার মর্যাদা রেখেছেন। এই পেশাকে ব্যবহার করে নিজের আখের গোছানোর যে চল চলছে, সেই চল তারা জারি রেখেছেন। সেটায় যে তেমন ভাটা পড়েনি তা দেখাতে কমবেশি সব সাংবাদিকই ব্যাকুল ছিলেন। বরং নিত্যনতুন সাংবাদিক, এই পেশায় তাদের দক্ষতার পরিচয় দিলেন। এমন ঘটনার পরে দর্শনীয় হয়ে ওঠে ফেসবুক। কটাক্ষে কটাক্ষে ভরপুর সব স্ট্যাটাস। তবে ফেসবুক দেখে মনে হলো, সংবাদ সম্মেলনের চেয়ে আজকের হিট টপিক হচ্ছেন আল্লামা শফি। তার সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, মূর্তি তার নিজেরও পছন্দ হয়নি। ব্যস আর যায় কোথায়, ফেসবুক আর ব্লগে, নাস্তিক বাহিনী কি-বোর্ডে ঝড় তুলে ফেলল। ‘দেশ বাংলাস্তান’ হয়ে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগে ফেরত গেল, আল্লামা সাহেব পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন… যাকে বলে ক্রিয়েটিভিটি অ্যাট ইটস বেস্ট। বরং পড়তে পড়তে আমার হাঁপিয়ে ওঠার দশা। বাঙালি পারেও। শাকিব খানের বিবাহিত জীবন নিয়ে নষ্ট করার মতো অযথা সময়েরও যেমন অভাব নেই, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে গপ্প ফাঁদতেও তেমনি এদের জুড়ি নেই।
এনিওয়ে, আমার ধারণা বাঙালি আরও কিছুদিন এ নিয়ে মাথা ঘামাবে। অপু আর শাকিবের বিয়ের পরিণতি নিয়েও অনেকে দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটাবে। দোষ কার বেশি তা নিয়েও চলবে বিতর্ক। প্রথম আলো কেন এই সংবাদকে শিরোনাম করল তা নিয়েও দেখলাম এক বেকুব চিন্তায় মাথার চুল পাকাচ্ছে। ব্যাপারটা খারাপ, তা বলছি না। এদেশের টিভির প্রোগ্রামের যা অবস্থা, তাতে কিছু দর্শক ওপারের টিভি দেখছেন আর কেউ কেউ বিনোদনহীন এই নিস্তরঙ্গ জীবনকে বিনোদন দিতে আশ্রয়ণ নিচ্ছেন টক-শো আর আঁতেল বাহিনীর লেখালেখিতে। ইনফ্যাক্ট ফেসবুকের বিভিন্ন ট্রলই এখন অনেকের কাছে বিনোদনের শ্রেষ্ঠতম উপায়।
ওয়েল, আমার মতো নিয়মিত ফেসবুকারদের জন্য ফেসবুকিয় ট্রল থেকে আনন্দ নেওয়া ব্যাপারটা অনেকটাই স্বাভাবিক। আমরা বরং অপেক্ষা করে থাকি দেশের রাজনীতিবিদরা কবে উদ্ভট কিছু করবেন, আর ট্রলিং শুরু হবে। তাই ভারত সফর থেকে বরং অনেক বেশি আগ্রহী ছিলাম কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির খবর নিয়ে। এমন সংবাদের পরে নাস্তিক তথা ধর্মবিদ্বেষী কিংবা মতান্তরে প্রগতিশীলদের আহাজারি যে শুরু হবে, সে ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলাম। এতটাই যে, ট্রলিং না দেখলেই বরং অবাক হতাম। তেমন কিছু যেহেতু হয়নি, তাই বলাই বাহুল্য। জেনে খুশি হলাম, দেশের এই বেকুব বাহিনী এখনো বেকুবই আছে, আর তাদের ছাগলামিও যথারীতি অব্যাহত আছে। থ্যাঙ্ক গড।
আচ্ছা, ফেসবুক আর ব্লগের আঁতেলদের কি আমি একটু বেশি সমালোচনা করছি? ও, কাম অন। ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করা যে কেউই জানে এদের দৌড়। যুক্তি, তর্ক, তথ্য, এনালাইসিস, গালাগালি, ভীতি প্রদর্শন… কি নাই এদের লেখায়। তবে বিষয়বস্তু ঘুরেফিরে একটাই, ধর্ম। ধর্মকে খেদাও, দেশ শান্তিতে হাবুডুবু খেতে শুরু করবে। দেশ গঠনে এরা এমন সব বুদ্ধি দেয়… যাকে বলে ‘জুড়ি মেলা ভার’ টাইপ। ঠিক ভার বলা ঠিক হচ্ছে না, এদের জুড়ি আছে। মোল্লা বাহিনী। এরা যেমন গল্প শোনায়, ধর্মীয় শাসন কায়েম হলে দেশে আর কোনো সমস্যা থাকবে না, এরাও একই গোয়ালের গরু, ‘কমিউনিজম শুধু আসুক, শান্তি রাখার জায়গা পাবা না।’
এরা আবার একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারে না। সত্তর আর আশির দশকে যখন সোভিয়েত রুবলের দৌরাত্ম্যে এরা ছড়ি ঘোরাত, তখন এদের কট্টরতম সমালোচক ছিল মোল্লা বাহিনী। সোভিয়েত পতনের পরে এদের সবচেয়ে বেশি কটাক্ষ করেছে বোধহয় মোল্লা বাহিনী। আর এখন? কোথাও কোনো আত্মঘাতী বোমা হামলা হলে কিংবা কোনো সহিংস কার্যক্রমে কোনো মুসলমানের নাম আসলে মোটামুটি এদের ঈদ শুরু হয়ে যায়। কটাক্ষ করবার পালা এবার কমিউনিস্টদের। একটু এদিক-ওদিক করে সবার বক্তব্যেই থাকে একই কথা, ‘সব নষ্টের গোড়া এই ধর্ম’। কেউ এক কথায় লেখে আর কেউ ভাব সম্প্রসারণ করে দুই পাতা ভরায়।
সে করুক, আমার আপত্তি নেই। বাম রাজনীতির এই দুর্দিনে ফেসবুকে বিপ্লব করা ছাড়া এদের আর তেমন কোনো উপায়ও নেই। অতি আঁতলামি করে করে প্রথমে চীন আর মস্কোপন্থি হলো। এরপরে একেকজন নেতা নিজে নিজে একেকটা দল বানিয়ে দেশে বাম রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। অবশেষে বিভিন্ন দলে যোগ দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে আবার ধর্মের কাছেই ফেরত আসল।
মূলত দুদিন পর পর নিজেদের মধ্যে ক্যাচাল লাগানো ছাড়া এদের আর তেমন কোনো কাজ নেই। বাম রাজনীতি করে যে আর কিছু হবে না, বুঝে গেছে। তার চেয়ে বরং এসব নাস্তিকবাদী লেখালেখি করে যদি একবার মৌলবাদীদের কাছ থেকে থ্রেট আদায় করা যায়, তবে আর পায় কে। সোজা বিদেশি অ্যাম্বাসি। এরপরে আসাইলাম, অ্যান্ড দেন বিদেশে স্বর্গের জীবন। আর মাঝে মাঝে দেশের জন্য মায়া কান্না।
এত কাসুন্দি ঘাঁটছি একটা কারণে। সুপ্রিম কোর্টের মূর্তি বা ভাস্কর্য। এই মুহূর্তের টক অফ ফেসবুক। এতদিন প্রধানমন্ত্রী ঝেড়ে কাশেননি। আজ কেশেছেন এবং নাস্তিকদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ঠিক বিপক্ষে না, বলা উচিত ভিন্ন অবস্থান। মূর্তি জরুরি কি না, কিংবা মূর্তি সরালে রাষ্ট্রের ঘাড়ে ধর্ম চেপে বসবে কি না এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনই কিছু বলেননি। বলেছেন এর নান্দনিকতা নিয়ে। গ্রিক দেবীকে শাড়ি পরানো পছন্দ করেননি, আর মূর্তিটাও পছন্দ হয়নি। এতেই গোস্যা হয়েছেন নাস্তিক বাহিনী। তো সারাংশ হচ্ছে তার পছন্দ অপছন্দও এখন থেকে এই নাস্তিক বাহিনী ঠিক করে দিবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো কিছু কারও যদি পছন্দ না হয়, তবে তিনি কি বলবেন? পছন্দ হয়নিই তো বলবেন। নাকি মিথ্যা বলবেন? আসলে সমস্যা সেখানে না, সমস্যা হচ্ছে যেহেতু হেফাজত আপত্তি জানিয়েছে, তাই যেকোনো মূল্যেই হোক এ মূর্তি রাখতে হবে, এই হচ্ছে নাস্তিক বাহিনীর অবস্থান। কিছুদিন আগে জ. ই. মামুন এমনই একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনাকে নিয়ে। রামপাল নিয়ে খালেদা জিয়া আপত্তি করায় নাকি শেখ হাসিনা রামপালের ব্যাপারে আরও একরোখা হয়ে গেছেন। বলতে চাইছেন, উনি দাবি না তুললে, হয়তো শেখ হাসিনা সেকেন্ড থট দিলেও দিতে পারতেন, এই আর কি। সো, কারও একরোখা অবস্থান তৈরির দায় সম্পূর্ণরূপে বর্তায় অপরের দাবির ওপর।
উপসংহার হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কোন পথে চলবেন সে সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়ে ফেলেছেন। ধর্মীয় গ্রুপকে উনি খেপাবেন না। নাস্তিক বাহিনী ক্ষেপে ক্ষেপুক। এতে গুটিকয়েক ফেসবুকিয় আঁতেল হয়তো কিছুদিন ফেসবুকে তাফালিং করবে, এই যা। এর বেশি আর কিছু হবে না। বরং এই মোল্লা বাহিনীকে খেপালে এরা দলে দলে রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। সো, টু কাট লঙ স্টোরি শর্ত, এই মুহূর্তের বাস্তবতা হচ্ছে, ‘নন টাচ টেকনিক’। তুমিও আমাকে ঘাঁটাবে না, আমিও তোমাকে ঘাঁটাব না।
মাশরাফিও যেমন হাতুরুসিংহের সঙ্গে বিবাদে জড়াননি, প্রধানমন্ত্রীও তেমনি ভারতকে চটাননি। হেফাজতকেও মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করছেন, প্রধান বিচারপতিকেও সম্ভবত মিষ্টি কথাতেই রাজি করাবেন। নাস্তিকদের সঙ্গে রাখতে গেলে যে কয়টা ভোট পাবেন, তার চেয়ে হারাবেন বেশি। ধর্মকে আক্রমণ না করা বাম কিংবা আওয়ামী হতে রাজি হওয়া বামদের তিনি দানা খাওয়াতে রাজি আছেন তবে পর্ণ লেখা নাস্তিকদের নয়।
যারা আসাইলামের ধান্ধায় দেশ ছেড়ে ভাগছেন, ভাগেন। বাট যারা এদেশে আছেন, থাকবেন কিংবা থাকতে চান সর্বোপরি এদেশে রাজনীতি করতে চান, তারা ভালোমতোই জানেন, ধর্মকে রাগিয়ে এদেশে রাজনীতি করা সম্ভব না। কতটা কম্প্রোমাইজ করতে হবে কিংবা ধর্মের কতটুকু অংশকে মেনে নিতে হবে, তা নির্ভর করছে মোল্লা বাহিনীর জনবলের ওপর। আর ওদের জনবল বাড়ে বাধা পেলে। তাই ফেসবুকিয় আঁতেল সমাজ, গেট ইট স্ট্রেট অ্যান্ড গেট ইট ক্লিয়ার, প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান হচ্ছে, নো ঝামেলা উইথ আল্লামা সাহেব, বরং গুড বাই টু নাস্তিক বাহিনী। ক্লিয়ার?