মৌলবাদী প্রেমে শেষ রক্ষা কার হবে?
১৭ মার্চ থেকে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, কুমিল্লায় একের পর এক জঙ্গি হামলা আর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মাঝে মার্চের শেষদিন পর্যন্ত এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্যে ছিল পুরো দেশ। এবারের স্বাধীনতা দিবসটি তাই কেমন কেমন করে যেন খুব নীরবে চলে চলে গেল। অন্যান্যবারের মতো তেমন উদ্দীপনা ছিল সব মানুষের মাঝে। আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি বর্ষবরণ উৎসবও ছিল নির্জীব, রঙহীন। বিমর্ষতায় মিলিয়ে গেল ধর্ম-গোত্র-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের ঐকতানের সুর পহেলা বৈশাখ।
জাতিসংঘ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার পর এবারের বাংলা বর্ষবরণ উৎসব ভিন্নমাত্রা পাওয়ার কথা ছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দেশজুড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার। কিন্তু পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামসহ কথিত ইসলামি দলগুলোর নতুন করে ফতোয়া আর তাদের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ হঠাৎ করেই যেন থমকে দাঁড়াল।
নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। জঙ্গিগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য তো এটিই। ভয় আর আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সবকিছু আদায় করে নেওয়া হবে। তাদের আক্রমণের ভয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করার মানে প্রকারন্তরে মৌলবাদীদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে হয় আমার কাছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুই তো হয় বেলা গড়ানোর পর। অনুষ্ঠান শুরু হতে না হতেই শেষ করার নির্দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রাটিও এবার আর আগের মতো বর্ণিল ছিল না। সারাদেশে বৈশাখী মোলার আয়োজন ছিল সাদামাটাভাবে, আগের তুলনায় অনেক কম। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কিছু পদক্ষেপ নিতেই পারে। কিন্তু অনুষ্ঠান কাটছাঁটের এই নির্দেশনা যদি দুই-একবারের জন্য হতো, ধরে নিতাম বিশেষ একটি পরিস্থিতির জন্য এই ব্যবস্থা। এই কাটছাঁট তো চলছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রায় এক দশক ধরে অসাম্প্রদায়িক বাংলার সার্বজনীন এই উদযাপন ধীরে ধীরে একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের আপোসকামী মানসিকতায়। বৈশাখকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউট এলাকার দেয়ালচিত্র পোড়া মবিল দিয়ে কারা নষ্ট করল তা বুঝতে কারোর কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে তার অর্থনৈতিক ভিত উপড়ে ফেলার আগে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক চিহ্ন মুছে ফেলার। এ কথা বিজ্ঞজন মাত্রই জানেন। এদেশের মৌলবাদীদের অন্যতম টার্গেটও সেটি। মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক চিহ্ন মুছে ফেলার টার্গেট যেমন ছিল আইএস জঙ্গিদের। প্রায় ৯০ ভাগ সফলও তারা। ইরাক, সিরিয়ায় মানবসভ্যতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেসোপটেমিয় সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন এরই মধ্যে প্রায় সবটুকু ধ্বংস করে ফেলেছে। প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনা ও সামগ্রী ধ্বংস আর লুটের মহোৎসব চালাচ্ছে চরমপন্থি গ্রুপ আইএস। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাত হাজার বছর আগের আলেপ্পোর পুরনো শহর, দামেস্ক, বসরা, উত্তর সিরিয়ার মৃত শহরগুলো, চ্যাভালিয়ার্স দুর্গ ও পালমিরার গ্র্যাকো-রোমান স্থাপনা।
ইরাকের মসুলে অ্যাসিরীয় সভ্যতার স্মৃতিধারণ করা গ্রিন চার্চসহ, ইমাম আইন-আল-দীনের সমাধি, জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন ভাস্কর্য ও মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে আরও আগেই। সিরিয়ার রাক্কা শহরে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে স্থাপিত অ্যাসিরীয় প্রবেশদ্বারের সিংহমূর্তি ভেঙে ফেলেছে তারা। এমনকি আইএস জঙ্গিরা গুড়িয়ে দিয়েছে ইসলাম ধর্মের অন্যতম নবীর নামে করা হজরত শায়েত (আ.) মসজিদ এবং হজরত ইউনুস (আ.) মসজিদ। আইএসের বক্তব্য, মসজিদগুলো প্রার্থনার স্থান নয় বরং ধর্মত্যাগের স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের ১০ হাজারেরও বেশি মূল্যবান বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি প্রাচীন পা-ুলিপি ছিল। ভাঙচুর করেছে গ্রন্থাগারের পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি। ইরাক-সিরিয়ায় আইএস নিজস্ব কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অস্ত্রের জোরে, বোমার আঘাতে ঐতিহাসিক স্থাপনা, ভাস্কর্য, জাদুঘর, গ্রন্থাগার ধ্বংস করলেও এদেশে খুব ঠা-া মাথায় আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতায় টিকে থাকতে শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করছে বারবার এবং নগ্নভাবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ-এর শাসন আমলেও চলছে একই প্রক্রিয়া।
জামায়াতী আদর্শের অন্যতম সহযোগী সাম্প্রতিক সময়ে চমক জাগানিয়া হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক (!!) ১৩ দফা দাবিনামার অন্যতম দাবি ছিল সারাদেশের ভাস্কর্যগুলো অপসারণের। শুরু হয়েছে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য সরানোর প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে। হেফাজতের সব দাবিই একে একে মেনে নেওয়া হচ্ছে। স্কুলের পাঠ্য বইগুলো সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। এটিও সেই ১৩ দফার অন্যতম দাবি। জাতীয় পতাকা উত্তোলনে অনীহাÑ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি থাকা কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। হোফাজতের দাবিগুলো মেনে নেওয়াটা সরকারের আপোস নাকি কৌশল, তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। বলি, আপোস বা কৌশলÑ যেটিই হোক তার কোনোটার পরিণামই সুখকর নয় কারোর জন্য। ভোটের রাজনীতির হিসেব নিকেষে জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ে তোলে বিএনপি। তারপর স্বাধীনতাবিরোধী সেই শক্তি পরিণত হলো বিষবৃক্ষে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় জন্ম নিতে থাকল জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো। জামায়াত নির্ভর সেই বিএনপি এখন অনেকখানি জনবিচ্ছিন্ন। এবার আওয়ামী লীগের হাত ধরে হোফাজতের যাত্রা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুখে জিরো টলারেন্স নীতি আর জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে আদর সোহাগে হেফাজতে রাখা একসঙ্গে চলতে পারে না। ভোটের ব্যাংকের হিসেব নিকেষে অথবা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে যতই কাছে টানা হোক না কেন, সুযোগ বুঝে হেফাজতের ছোবল সরকারের কাঁধে পড়বেই, যার খেসারত দিতে হবে পুরো জাতিকে। ২০১৩-এর হেফাজতি তা-ব কি আমরা এত সহজে ভুলে যাব?
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সড়হলঁৎঢ়ধহহধ৭৭৭@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান