আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন রাজনৈতিক অপকৌশলের কারণে বাংলাদেশ একটা ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য অপসারণে হেফাজত ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান, কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি নিয়ে গত কয়েকদিনে যে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো এসব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ভুল সিদ্ধান্ত। ভুল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলে জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। কিন্তু অহমিকা বোধের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত টিকিয়ে রাখলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সরকারÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, হেফাজতের সব দাবিই ক্রমাগতভাবে সরকার মেনে নিচ্ছে। কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হলো। এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া হওয়া সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এতে আমরা বুঝে নিচ্ছিÑ সরকারের সম্মতি অনুযায়ীই এই পরিবর্তন করা হয়েছে। কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরা-ই হাদীসকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ¯œাতকোত্তর ডিগ্রির সমপর্যায় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর একটি মানবিক দিক আছে। প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনা করতে গিয়ে বেশ বড় রকমের সমস্যা হয়ে গেল।
তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছেÑ একমুখী শিক্ষার কথা। বাংলাদেশে এ যাবৎ কোনো সরকারই এই বিধান অনুসরণ করেনি। কারণ বাহাত্তর থেকেই বাংলাদেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। আর খুব সম্প্রতি নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল, তিনিও স্বীকৃতি দিলেন কওমি মাদ্রাসাকে। যার উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের পাঠ্যসূচি কি কারও জানা নেই। কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। জাতীয় পতাকাও উড়ে না। কওমি মাদ্রাসার প্রধান আহমদ শফী, তিনি সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী একজন মানুষ। এই স্বীকৃতির ফলে শুধু সংবিধানই লঙ্ঘিত হলো না বরং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধগোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করা হলো। ধরা যাকÑ কওমিরা দাওরা-ই হাদীস ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি পেল। তাতে কি লাভ হবে তাদের। তারা তো হাদীস কোরআনোর বিকৃত ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই পড়ালেখা করে না। ফলে তাদের কর্মসংস্থান হওয়াও তো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তারা কোথায় চাকরি পাবে। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়া আর কোথাও তো তাদের চাকরি হবে না। তাহলে লাভটা কি হলো?
কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি দেওয়ার আগে করণীয় কি ছিল বা কি করতে পারত সরকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করে তা ক্ষতিয়ে দেখা যেত যে, কওমি মাদ্রারাসার পাঠ্যসূচি কিভাবে আধুনিকীকরণ করা যায়। আধুনিকীকরণের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার পর এই স্বীকৃতি দিলে ভালো হতো। এখন যেটা হয়েছে আগেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের পাঠসূচি সেকেলে। এবং সম্পূর্ণ প্রগতি পাঠ্যসূচিতে পড়াশোনা করছে। হাদীস এবং কোরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা ছাড়া এরা আর কিছুই পড়াশোনা করে না। কওমি শিক্ষার স্বীকৃতির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ আহ্লে সুন্নতও করেছে। আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটি খুব ভেবেচিন্তে নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে, রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এটা বুমেরাং হবে। অর্থ্যাৎ আত্মঘাতী হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই ইতিহাসবিদ বলেন, গোটা ব্যাপারটাই একটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে আমাদের কাছে। কিন্তু এই রাজনৈতিক কৌশল সফল হবে না। কারণ এই ধর্মান্ধগোষ্ঠী কোনোদিনই আওয়ামী লীগের বাক্সে ভোট দিবে না। উপরন্তু আওয়ামী লীগকে যারা নৈতিকভাবে সমর্থন করেন তারাও অনেকটা সংশয়ের মধ্যে পড়ে যাবেন যে, আওয়ামী লীগ কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করছে কি না। আমরা তো হরহামেশাই বলি, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি করা। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছেÑ আওয়ামী লীগও হেফাজতের সঙ্গ নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাহলে আওয়ামী লীগের কি আর নৈতিক অধিকার আছে বিএনপিকে এ কথা বলার যে, তারা যেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ে। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, হেফাজতও তাই। কাজেই রাজনীতিতে সমীকরণ যা হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রেক্ষাপটে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অনেক অর্জন আছে। বাঙালি জাতি অনেক কারণেই তার কাছে ঋণী থাকবে। কারণ তিনি এমন অনেক কাজ করেছেন যা এর আগে কখনো হয়নি এখানে। তার কাজের জন্যই বলা যায়, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। অবশ্য উন্নয়নের সংজ্ঞা বা সংজ্ঞার্থ নিয়ে আমার ভিন্নমত আছে, তা সত্ত্বেও বলবÑ বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। তারপরও যখন তিনি এমন কাজ করেন তখন তার পক্ষের লোকজনের মধ্যেই সংশয় ও সন্দেহ জাগে। পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতিকরণ, ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান, কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি বা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেওয়ার মানেই হচ্ছে শেখ হাসিনার অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাওয়া। আমরা খুবই দুঃখিত এবং একই সঙ্গে শঙ্কিত যে, এর দূরবর্তী ফলাফল কি হবে তা নিয়ে।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, হেফাজতে ইসলাম যখন ঢাকা অবরোধ করেছিল তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জাতির উদ্দেশ্য আহ্বান জানিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তখন এই শেখ হাসিনা সরকারই হেফাজতকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছিল। জনগণের বাহবাও পেয়েছিল। এখন সেই শেখ হাসিনার সরকারই এখন হেফাজতের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অর্থ্যাৎ বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে জনগণ সাড়া না দিলেও আওয়ামী লীগ সরকার সাড়া দিচ্ছে, পরিস্থিতিটা এমনই হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ সরকার কি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে থাকবে নাকি হেফাজতের মতো কয়েকলাখ মানুষের সঙ্গে থাকবে, এই সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, প্রগতির ধারণাÑ এসব জলাঞ্জলি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো কৌশল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে চলে যাচ্ছে। এবং একটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে রাজনৈতিক অপকৌশল অবলম্বনের কারণে। রাজনীতিতে কৌশল থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মৌলিক আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে যদি কৌশল গ্রহণ করা হয় তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশলের নামে যে কাজগুলো হচ্ছে তার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ আর অসাম্প্রদায়িক থাকছে না। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক মুখে মুখে, বাস্তবে নয়। কারণ পাঠ্যপুস্তকে এখন যা শেখানো হবে তা দিয়ে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আহমদ শফীর মতো নাগরিক গড়ে উঠবে। এখানে আর প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার কোনো নাগরিক গড়ে উঠবে না। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতা থাকছে কিনা তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।
ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলায় আশাবাদী বিশিষ্ট এই ইতিহাসবিদ। তিনি বলেন, সমাজে এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা রক্তে অর্জিত বাংলাদেশকে তার মৌলিক জায়গায় রাখতে বদ্ধপরিকর। তারা কখনোই বাংলাদেশকে বিপথে যেতে দেবে না। নাগরিক সমাজেও স্বচ্ছচিন্তার কিছু মানুষ আমরা পাই, ওই জায়গাটাই আমাদের আশা এবং ভরসা। ভাস্কর্য অপসারণ, কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি, পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতিকরণ নিয়ে নাগরিক সমাজ থেকে প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া আসছে এই রাজনৈতিক অপকৌশলভিক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সরকারের এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে। টিভি টকশোর গত কয়েকদিনের অনেক আলোচনা আমি শুনেছি। আমি নিজেও কথা বলেছি। টেলিভিশনে যারা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তাদের মুখ থেকে সমর্থনসূচক কোনো বক্তব্য পেলাম না। এটাই হচ্ছে আশার কথা। জনমতকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যা হয়ে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই শিক্ষাটা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করার ফলেই বাংলাদেশ অনিবার্য হয়েছিল। সেই বাংলাদেশে যদি জনবিচ্ছিন্ন, প্রগতিবিরোধী কোনো নীতি এবং কর্মকা- চলে তাহলে সমস্যা হতেই পারে। এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও বটে। তবে এখনো আশার বিন্দুগুলো আছে কোথাও না কোথাও।
তিনি বলেন, বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। গণভোটও হতে পারে এ বিষয়ে। যদিও এত ছোট বিষয়ে গণভোট হতে পারে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবু প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন এমন সিদ্ধান্ত নেন তখন তা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। জাতি যা চায় না প্রধানমন্ত্রী তা কেন করেন। ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে তুষ্ট বা তোষণ করার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থি সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করি। সরকারের উচিত দ্বিতীয় চিন্তার সুযোগ রাখা।