খুদে বার্তায় নববর্ষের শুভেচ্ছা
ড. সা’দত হুসাইন
বছরের বিশেষ দিনসমূহে পছন্দের লোকজনকে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি অনেক দিন থেকে চলে আসছে। এখন মোটামুটি বছরে ছয়টি দিন এ জন্যে নির্ধারিত হয়ে আছেÑ দুই ঈদ, দুই নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। অনেক বছর আগে, ধরে নেওয়া যায় স্বাধীনতার আগে শুভেচ্ছা বিনিময় দুই ঈদের মধ্যে সীমিত ছিল। অন্য ধর্মের লোকজন হয়তো তাদের নিজেদের মধ্যে ধর্মাচার অনুযায়ী শুভেচ্ছা বিনিময় করত। ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বিনিময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে উপস্থিতির মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। মসজিদ, মন্দির, গির্জা এবং উপাসনালয়ে কোলাকুলি, করমর্দন, পদধূলি নেওয়া কিংবা হাত তুলে অভিবাদনের মাধ্যমে একে অপরকে শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, আশীর্বাদ জ্ঞাপন করত। এর মধ্যে আবেগ অনুভূতির সম্যক প্রকাশ ঘটত। ব্যাপারটি আমার পছন্দ ছিল। এ প্রক্রিয়ায় আমি একজন সক্রিয় অংশীদার ছিলাম।
ধীরে ধীরে পদ্ধতির পরিবর্তন হতে থাকে। বিশেষ দিনে চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি কখনোই ঠিক চালু হয়নি। আমি জীবনে চিঠির মাধ্যমে একটি শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছিলাম। বিজয় দিবস উপলক্ষে সামাদ ভাই (ড. এস, এ সামাদ) একটি সুন্দর শুভেচ্ছা পত্র লিখেছিলেন আমাকে, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। চিঠি খানা এখনো আমার কাছে সযতেœ রাখা আছে। চিঠি চালু না হলেও যেটি ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেল তা হলো শুভেচ্ছা কার্ড। বিশেষ দিনসমূহে রং বেরং-এর নানা কার্ডে টেবিল ভরে যেত। এর অনেকগুলো ক্ষমতার টেবিলের সাথে সংম্পৃক্ত; ক্ষমতা থেকে দূরে থাকলে এর সংখ্যা কমে যেত। কিছু কার্ডে শুভেচ্ছা বার্তাটি প্রেরক নিজ হাতে লিখত। বেশির ভাগ কার্ড প্রস্তুতকারী ফার্ম এটা ওটা লিখে ছাপিয়ে রাখত। প্রেরক পছন্দ করে কার্ডটি কিনে ছাপানো বাণীসহ তা পাঠিয়ে দিত। প্রেরক হয়তো উত্তর আশা করত। উত্তর যেত কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বড় বড় সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা ‘ফ্যাক্সিমিলি’ দিয়ে কার্ড পাঠিয়ে দিত। ব্যক্তিক আবেগ বা সম্পর্কের কোনো ছাপ এত থাকত না।
গত ক’বছর থেকে কার্ড পাঠানোর রীতিও অনেক কমে গেছে। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে খুদে বার্তা বা এসএমএস। প্রথম দিকে প্রেরক নিজে লিখে খুদে বার্তা পাঠাতো। আমি সোৎসাহে প্রায় সাথে সাথে উত্তর দিতাম। এখন প্রেরকরা বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। প্রযুক্তিকে কব্জা করে তারা খাটা-খাটুনি কমিয়ে ফেলেছে। অনেকেই নেটে পাওয়া ‘ইমেজ’ ও বার্তা আপলোড করে তা গ্রুপে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অতি চালাক ব্যক্তিরা আরও এক ডিগ্রি এগিয়ে একক বা দ্বৈত মালিকানাধীন আইটি ফার্মের মাধ্যমে পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে বহুলোকের কাছে খুদে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে। এসব বার্তার উত্তর প্রেরকের কাছে পৌঁছানো দুস্কর। কারণ ‘ভেন্ডার’ তা গ্রহণ করে না। উত্তর বার্তা ফিরে আসে। মজা হয় অফিসার্স ক্লাবের সদস্যদের ক্ষেত্রে। পদাসীন এবং পদ-প্রার্র্থীরা একই নম্বর থেকে ডজন ডজন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়। মোবাইল সেট বার্তায় ভরে যায়। এ ধরনের বার্তা অর্থহীন, ভাবলেশহীন। এর উত্তর সঠিকভাবে দেওয়া যায় না, দিলেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। ডিলিট করে ফেলতে হয়, যা সময়ের অপচয় মাত্র।
সেই আপ্তবাক্যটি আমার মনে পড়ছেÑ বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। প্রযুক্তি আমাদের ব্যক্তিক সম্পর্ককে বাণিজ্যিক আবরণে ঢেকে ফেলেছে। পরিচিতদের কাছে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো এখন এক ধরনের খেলায় (এধসব) পরিণত হয়েছে। বছরে কয়েকবার আমরা এ খেলায় মেতে উঠি, নিজের আনন্দে। প্রেরিত বার্তা কোথায় গেল, কার কাছে গেল আইটি অপারেটররাই তা ভাল জানে। প্রেরক শুধু জানে বহু লোক তার বার্তা পেয়েছে। কে কিভাবে তার বার্তা গ্রহণ করেছে, এ ব্যাপারে তার কোনো উদ্বেগ নেই। বার্তা ঘেঁটে কোনটি প্রেরক নিজে পাঠিয়েছে তা বেছে নিতে সময় লেগে যায়। এখন আমি শুধু প্রেরকের নিজ হাতে রচিত বার্তার উত্তর দিই। অন্য বার্তা পড়ে থাকে। পরে ‘ডিলিট’ করে দিয়ে স্ক্রিন পরিষ্কার করে ফেলি।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব এবং সাবেক পিএসসির চেয়ারম্যান