হেফাজতের দাবি এবং জনআকাক্সক্ষার বাংলাদেশ
ওয়াসিম ফারুক
দুইশো বছর ব্রিটিশ শাসন শেষে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। এক অংশে বাংলাদেশ, অপর অংশ পাকিস্তান। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের দূরত্ব প্রায় ৯শ কিলোমিটার। মতান্তরে ১১শ কিলোমিটার। তাই ধর্মের ব্যবহার এ অঞ্চলে অনেক পুরোনো। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। যদিও আইনের দৃষ্টিতে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা পুরোপুরি বেআইনি। কিন্তু কে মানে কার আইন! ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করে যাচ্ছে এমন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত তার হিসাব বোধ করি খোদ নির্বাচন কমিশনও দিতে পারবেন না। যদিও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামিক রাজনৈতিক দল আছে ১০টি। আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কদর কম না। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাজোটে বেশকিছু ইসলামি দল আছে। আর বিএনপির ২০ দলীয় জোটেও জামায়াতসহ ইসলামি রাজনৈতিক দলের দাপট কম না। আবার ভোটের আগের আমরা দেখি বিভিন্ন দলের প্রধানরাসহ বড় বড় নেতারা চলে যান সৌদি আরবে ওমরাহ হজ করতে। তারা ধার্মিক হবেন তার জন্য আমার মোটেও কোনো আপত্তি নেই। বরং তাদের বিশ্বাসের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে আজ এক মহাশক্তি হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে! ২০১৩ সালের আগে যদিও তেমন কেউ এই সংগঠনটির নাম জানত না, তবে এই সংগঠনটির জন্ম ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠনটি বাংলাদেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। ২০১১ সালে তারা বাংলাদেশ নারী উন্নয়ননীতি, ২০০৯-এর কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং ওইসব ধারাগুলো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে জনসম্মুখে আসেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সমগ্র জাতি যখন একাত্তরে মানবতাবিরোধী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে একত্রিত তখনই বাংলাদেশের প্রধান ধর্মভিত্তিক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও তাদের সহযোগিদের মদদে একাত্তরের মানবতাবিরোধী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য আদা-জল খেয়ে নামে। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যারা জোরালো আন্দোলন করে আসছিলেন তাদেরকে নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের ফাঁসি দাবি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন ও সমাবেশ শুরু করে এই হেফাজতে ইসলাম, যার প্রধান হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক শাহ আহমদ শফী। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি নামে হেফাজতে ইসলাম নারকীয় তা-ব চালিয়েছিল, যা দেশের মানুষকে ভুলতে কয়েক যুগ লেগে যাবে।
২০১৩ সালের ৫ মে পর থেকে হেফাজতে ইসলাম বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনের ভেতর একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। যদিও সরকারের ভেতরের অনেকেই মুখে মুখে হেফাজতে ইসলাম ও এর প্রধান শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নানা মন্তব্য করে আসছেন তবে সেই মন্তব্য তেমন কার্যকর হয়নি। বরং ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি তুলেছিল সরকার ধীরে ধীরে তাদের খুশি করতে সেই ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার একটি ছিল ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।’ এই দফাকে সামনে রেখেই আমাদের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্য টিকে সরানোর জন্য নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো। অতি সম্প্রতি গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরানোর জন্য যারা আন্দোলন করছেন তাদের সঙ্গেও সহমত পোষণ করেন।
হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই আমাদের অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের চরম বিরোধিতা করে আসছে, এমনকি নানা সময় নানাভাবে হুমকি-ধামকিও দিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের এই হুমকি-ধামকি আমাদের সাধারণ মানুষ কখনোই তোয়াক্কা করেনি। ২০০১ সালে ধর্মান্ধদের নারকীয় হামলার পরও বন্ধ হয়নি উৎসব। এবারও বাংলা বর্ষবরণ উৎসবকে শুধু বানচাল করাই নয়, মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধী নানা হুমকি-ধামকি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বর্ষবরণের অংশ হিসেবে সৃজিত শিল্পকর্মের ওপর দানবীয় হামলা চালায় উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। মঙ্গলবার গভীর রাতে চট্টগ্রামে পোড়া মবিল ছিটিয়ে চারুকলার শিক্ষার্থীদের আঁকা বর্ষবরণের দেয়াল চিত্রগুলো নষ্ট করে দেয়। আবহমান গ্রামবাংলার কৃষি সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়া, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আনন্দ প্রকাশের স্বাভাবিক সুন্দর ছবিও মৌলবাদীদের সহ্য হয়নি! পারলে তারা মানুষের ছবি শুধু নয়, উৎসবমুখর মানুষের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওরা বোঝাতে চেয়েছে বাংলা নববর্ষ পালন একটা বিশেষ ধর্মের মানুষের উৎসব এটা কোনো মুসলমানের নয়। অথচ নববর্ষ পালনের সঙ্গে ধর্মের যে কোনো যোগসূত্র নেই এটাই তো সত্য। শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলতে বাধ্য হয়েছেন, সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাংলা বছরের প্রথম দিন উদযাপন করে। এখানে ধর্মকে টেনে আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আদর্শ ও নীতি ভুলে গিয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে বিশেষ পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যার মূলনীতিই হলো ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি ক্ষমতায় আসা ও টিকে থাকার জন্য এই দলটি বারবার উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে মাথানত করে আসছে, যা দলটির আদর্শের সঙ্গে যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যাকে এটা মনে রাখতে হবে, এই মৌলবাদী গোষ্ঠী তার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিবে ঠিকই কিন্তু ভোটের বেলায় ফলাফল হবে হয়তো তার উল্টো।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়তে হলে বাংলার মাটি থেকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চিরকালের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান