একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী এবং আমাদের সমাজব্যবস্থা
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
পলাশ, বয়স ৩৪। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। প্রায়ই মারধর করত। ১০-১১ বছর বয়সে তাদেরই এক ক্লাসমেট মেয়ের প্রেমে পড়ে তারা দুবন্ধু। ওই বন্ধুর রোল নম্বর ছিল-০১, তার রোল ছিল-২ ও ওই মেয়ের রোল নং ছিল-৩। একদিন জুমার নামাজ শেষে তার ওই বন্ধু বলে, দোস্ত তোর কাছে একটি জিনিস চাইব, দিবি? সে বলে, হ্যাঁ দেব। বন্ধু বলে, এমনি বললে হবে না, কসম খেতে হবে। পলাশ বলে, কসম। বন্ধু বলে, তাহলে কুরআন ছুঁয়ে বল। মসজিদ থেকে কুরআন এনে শপথ করায় বন্ধু, যা চাইবে সে তা দিবে।
তখন বন্ধু বলে তুই আর বাড়ি ফিরে যাবি না, অন্যত্র চলে যা, তুই থাকলে ওই মেয়েকে আমি পাব না। পলাশ দ্বিধায় পড়ে। কিন্তু কুরআন ছুয়ে কথা দিয়েছে সেটি বরখেলাপ করবে কিভাবে? তার মন বলে, আল্লাহর কুরআন ছুয়ে শপথ ভাঙলে চরম গোনাহ হবে। তাই সে তার সঙ্গে থাকা ৭-৮ টাকা সম্বল করেই ফরিদপুর থেকে ঢাকা চলে আসে। কমলাপুর এসে এক হোটেলের সামনে কাঁদতে থাকে। তখন হোটেলওয়ালা তাকে হোটেলে কাজ করতে দেয়। তবে সেখানে তাকে প্রচুর মারধর ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। একসময় সেখান থেকে ৫০০ টাকা চুরি করে সে পালিয়ে মিরপুরে চলে যায়। মিরপুরে এক মাঠে বসে থাকা অবস্থায় দুজন লোক তাকে ফুসলায় বোম মারতে পারবি? সে বলে, আমি তো জানি না। তারা বলে, শিখিয়ে দেব। সে থেকে শুরু।
সে এক হরতালে বোমা মারে। পুলিশ তাকে দেখে ফেলে। কিন্তু সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তার সাহস ও বুদ্ধি দেখে তার কদর বেড়ে যায়। ক্রমশ সে বোমা বানাতে শিখে, এরপর দেশীয় অস্ত্র বানাতেও শিখে এবং দুর্দান্ত কিলার হিসেবে নাম কুড়িয়ে ফেলে(?)। চাঁদা না দিলে দিনে দুপুরে খুন করত। এ পর্যন্ত ৭টি খুন করেছে বলে জানায়।
১ম খুনÑ গরুর ব্যাপারীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। অন্য আরেক গ্রুপও সে সময় ওই লোকের কাছে চাঁদা আনতে যায়। তখন পলাশ প্রতিপক্ষকে গুলি করে মেরে ফেলে। এটি নিয়ে তেমন কিছু হয়নি, কেননা তার গ্রুপ ছিল অধিকতর শক্তিশালী। সে তখন কিছুদিন চিটাগাং-এ গা ঢাকা দিয়ে থাকে। একসঙ্গে ৩ খুন, ম্যানেজারের কাছ থেকে চাঁদা আনতে যায়। সে ৫ লাখ টাকা দাবি করে, ম্যানেজার বলে ৩ লাখ নিন। এতে তার মেজাজ বিগড়ে যায়, আমাদের কথার উপর কথা। সে বলে ৬ লাখ দিবি। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে গুলি করে। ওই লোক মারা যায়। তখন আরও দুজন এগিয়ে আসলে তাদেরও গুলি করে মেরে ফেলে। সে প্রায়ই ছদ্মবেশে অপারেশনে যেত। তার নাম ডাক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গডফাদারও বদল করত। রাজনীতির উচ্চ স্তর থেকে তাকে ব্যবহার করা হতো ও তাকে শেল্টার দেওয়া হতো। কিন্তু একসময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ও জেলে যেতে হয়।
অপরাধ জগতের অনেক খবর জানে বলে পুলিশ তাকে তাদের সোর্স হিসেবে নিয়োগ দেয়। পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সময় এক ‘খারাপ’ মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে মেয়েটিকে শুধু ভোগ করবে ভাবে। কিন্তু মেয়েটি তার পিছু লেগে থাকে। একসময় তারা বিয়ে করে। কিন্তু মেয়েটি তার খারাপ কাজ ছাড়ে না। তাই সে বউ নিয়ে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে সেও অপরাধ জগত থেকে দূরে থাকে, তার বউও খারাপ কাজে যেতে পারবে না। দূরে গিয়ে তার অবৈধ উপার্জন হারাতে হয়। সে এখন রিকশা চালায়। একদিকে আর্থিক অসঙ্গতি অন্যদিকে পুলিশের চাপ, তাই সে এখন দিশেহারা। আবার পুরনো জগত থেকে বিভিন্ন ‘মিশনের’ আহ্বান আসছে। একসময় টাকার অভাব ছিল না, চাইলে হাজার হাজার টাকা পেয়ে যেত। এখন দুপয়সা দিয়েও কেউ সাহায্য করে না। তার মনে হয় তাহলে কি আবার ওই অপরাধ জগতে ফিরে যাওয়াই সঠিক কাজ হবে?
তার বউ হজরত শাহজালালের মাজারে নিয়ে তাকে শপথ করায় যাতে সে তার বউকে কখনো না ছাড়ে। সে শপথের কারণে খারাপ জেনেও বউ ছাড়েনি। তার ভাষ্য, আল্লাহর কথা শুনতে গিয়ে আজ আমার এ অবস্থা। আমি এখন কি করব?
সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ : এক. কুরআন ছুয়ে শপথ: এটি আদৌ সঠিক কোনো কাজ কি না? ধর্মের মৌলিক জিনিস না জেনে ও না মেনে শুধু কুরআনের শপথের নামে যা কিছু করা কতটুকু ইসলাম সম্মত? ধর্মীয় গোড়া বিশ্বাস ও প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন পূর্ণভাবে জীবনে ধারণ করা এ দুয়ের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে তা আমরা কতটুকু শিখতে পেরেছি, শিখাতে পেরেছি? জঙ্গিবাদীরাও ইসলাম ও কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষা গ্রহণ না করে, খ-িত কিছু গোড়ামীর উপর দৃঢ় অন্ধ বিশ্বাসকে ধারণ করে ইসলামের নামে পুরোপুরি ইসলামবিরোধী নৃশংস কাজ করে যাচ্ছে। নামাজ রোজার নাম নেই, নিছক কুরআনের শপথের নামে অনেক জঘন্য কাজ আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। প্রকৃত আলেমদের তাই ইসলামের মূল ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে শুধু কুরআন শপথ করেছে বলে পলাশের মতোন মারাত্মক ভুল কেউ না করে।
দুই. মাজার শপথ: সেটি তো আরও নাজায়েজ কাজ। কিন্তু মাজার, পীর ভক্তদের সংখ্যা কি আদৌ কমছে? ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, বিজ্ঞানের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে না দিলে এ সব অপচর্চা কমার সম্ভাবনা কম। তিন. রাজনৈতিক শক্তির শেল্টারে পলাশদের মতোন ক্রিমিনাল তৈরি হয়। রাজনীতির শুদ্ধিকরণ কবে আসবে? পুলিশ প্রশাসনে দুর্নীতি, অপরাজনীতি বন্ধ করতে না পারলে সমাজে অপরাধ নির্মূল করা কঠিন কাজ। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সম্পাদনা: আশিক রহমান