কৃষকদের মাথায় তুলে রাখার দায়িত্ব কার?
দীপক চৌধুরী
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এ বছর কৃষকদের জীবনে যা ঘটেছে এটাকে ‘কৃষকের মরণ’ ছাড়া কিছুই বলা যাবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণকাজে অনিয়ম-গাফিলতি, অসময়ে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো ধান তলিয়ে গেছে। হাওরপাড়ের কৃষকরা দুঃশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন এখন। তারা বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন।
কৃষকরা শুধু নিজের জন্য চাষ করেন না, ফসল ফলান না। তারা দেশের প্রাণ। তারা আমাদের চালিকাশক্তি। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় তাদের থামাতে পারে না। ফসল তাদের যক্ষের ধন। এ সত্য স্বীকার করতেই হবে। উদাহরণ ও সম্মান দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, ‘কৃষকদের মাথায় তুলে রাখতে হবে।’ সেই কৃষক আজ বড়ই অসহায়Ñ তাদের চোখে জল, মুছে দেওয়ার লোক দেখা যাচ্ছে না।
সরেজমিনে সচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার মতো নয়। একসপ্তাহ ঘুরে বিভিন্ন হাওর দেখে আমি নিজেও অবাক হয়েছি। দুই সপ্তাহ আগেও চারদিকে ছিল সবুজ প্রান্তর। ধান আর ধান। কৃষকের মুখভরা হাসি। ভালো ফলনে কৃষকের ঘরে ঘুরে আনন্দের ঢেউ লেগেছিল। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানে ধানক্ষেতে এখন পনেরো ফুট পানি, থৈ থৈ পানি। শত শত নাম জানা না জানা হাওরে পানি, অকাল বন্যা। কৃষকের বুক ফাটা কান্না করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। গৃহস্থদের গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া সারি সারি করে বাঁধা থাকত গোয়ালে। সেইসব গোয়াল এখন খালি, শূন্য খাঁ খাঁ করছে। তারা মহাবিপদে। এগুলোকে কী খাবার দেবেন গৃহস্থরা। বুঝবার উপায় কী? জবাব নেই। গৃহস্থরা গরু-মহিষ-ছাগল ভেড়া নিয়ে বাজার-হাটে ছুটছেন কিন্তু দাম নেই, ক্রেতা খুবই কম; বিক্রেতা বেশি। পানির দাম যাকে বলে। নেত্রকোনার গৃহস্থ গৌতম তালুকদার। নিজেই চাষ করেন। কৃষি তার গর্ব। কিন্তু এ বছর বড়ই অসহায় তিনি। জানালেন, ২৯টি গরু বেচতে নিয়ে গিয়েছিলেন হাটে। অর্ধেক মূল্যও নেই।
কোটি কোটি টাকা মূল্যের ব্যুরো ধান তলিয়ে গেছে। পাকা বা সামান্য পাকা হলেও কিছু ধান গোলায় তোলা সম্ভব হতো কিন্তু এ বছর বাঁধ ভেঙে কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গত সোম-মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত হাওর সরেজমিনে দেখেছেন। সুনামগঞ্জে এক রাত থেকেছেন। জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামের মুখ থেকে কৃষকদের আহাজারি ও দুঃখের কথা শুনেছেন। জেলা প্রশাসক হয়েও শেখ রফিক জেলার তুফানখালির বাঁধে মাটি ফেলেছেন। বহু হাওর সরেজমিনে দেখেছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন, ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি এ অঞ্চলের কৃষকের। তুফানখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাজার হাজার হেক্টর জমি তলিয়েছে। শুধু তাদের প্রশ্ন ‘আমরা কী করব এখন?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুনামগঞ্জের শাল্লার এক কৃষক জানালেন, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে অভাবের সংসার। শেষ সম্বল দুটি গাই গরু (গাভী) বিক্রি করে বোরো ফসল বুনেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছিল। অনেকের মতো শাল্লার পোড়ারপারের অসহায় কৃষক হরিধন তালুকদার জানান, এ উপজেলার ছায়ার হাওর, ভা-ারবিল, কালের ডোবাসহ পুরো এলাকায় তলিয়ে গেছে সকল জমির ফসল। হাওরে থৈ থৈ পানি। কৃষকদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। সরকারি সাহায্য যাতে সঠিকভাবে পরিবেশন করা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
দিরাইয়ের টাঙনির হাওর, বরাম হাওর, চেপটির হাওরের সোনার ধান তলিয়ে গেছে। ধর্মপাশা উপজেলার ডুবাইল হাওরের প্রায় ৫০০ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সোনাতলা কাইক্কার ধাইর হাওরের প্রায় ২০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। জামালগঞ্জের হালির হাওরসহ ত্রিশটি ছোটবড় হাওর তলিয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, গুরমার হাওর ও জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া হাওর তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কৃষক আলী নূর বললেন, বৈশাখেই ঘরে এক ছটাক চাল নেই। বাঁচব কীভাবে?
সিলেট সদর উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন কৃষক তার শেষ সম্বল তিনটি গরু বিক্রি করে তিন একর জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। সব ফসল হারিয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখছেন এই তিনি। সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব মতে, জেলার ১৩টি উপজেলায় অকাল বন্যায় বোরো ফসল হারিয়েছেন দুই লাখ ১২ হাজার ৫৭০ জন কৃষক। এই ফসলই ছিল দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের একমাত্র অবলম্বন। ফসল হারিয়ে তারা পড়েছে ঘোর বিপদের মুখোমুখি।
দিরাইয়ের ভাটি বাংলা বাউল একাডেমি ও গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক দোলন চৌধুরীর জানালেন, কৃষকদের প্রথম সমস্যা হচ্ছে কৃষিঋণের ‘বোঝা’। এবার এই ঋণ কীভাবে তারা পরিশোধ করবেÑ এ প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ যুবক বললেন, আঞ্চলিক ভাষায় এখানে, ‘আখি’ দেওয়া হয়। অর্থাৎ পাকা ধান তলিয়ে গেলেও কৃষকরা পানির নিচ থেকে স্থানীয় কৌশলে শতকরা ৪০ ভাগ ধান তুলতে পারেন ডুব দিয়ে। এবার তা সম্ভব না কারণ, তলিয়ে যাওয়া সব ধান কাচা। এখন জরুরি কাজ হবে, প্রতিটি ওয়ার্ডে ওএমএসের চাল সরবরাহ করা। তরুণ ছেলেদের কাজে লাগানো।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান হাওর অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে এসেছেন। তার ভাষ্য, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণের গাফিলাতির বিষয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের জনমত অত্যন্তপ্রবল। আমি গাফিলতির বিষয়টি তলিয়ে দেখার এবং এজন্য কারা দায়ী তা নির্ধারণে একটি বড় কমিটি করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি।
প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের প্রশ্নের তোড়ে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০ কোটি টাকার গোপন তথ্য প্রকাশ হয়েছে সম্প্রতি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, প্রকৃত বরাদ্দ কত? সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে এর জবাবে সিলেট অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই জানান, সুনামগঞ্জে পিআইসির বরাদ্দ ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অথচ সুনামগঞ্জের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন এতদিন বলে আসছিলেন, বরাদ্দ কম। সুনামগঞ্জে পিআইসির বরাদ্দ ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে প্রাথমিকভাবে নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টিম অনুসন্ধানে নেমেছে।
ফববঢ়ধশপযড়ফিযঁৎু১০@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান