চারুকলার ক্যান্টিন, গরুর গোশত এবং সনু নিগম
কাকন রেজা
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে তুলকালাম। তেহারিতে গরুর গোশত দেবার প্রতিবাদে ভাঙচুর হয়েছে চারুকলার ক্যান্টিন। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে হিন্দু শিক্ষার্থীরা গরু খায় না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তেহারিতে গরুর গোশত দেওয়া হয়েছে, ক্ষোভটা ছিল এ নিয়েই। সোশ্যাল মিডিয়াও এ ব্যাপারে সরব ছিল। ‘ফেসবুকে’ও তুলকালাম। কদিন মন্তব্য, তর্ক-বিতর্ক, টিকা-টিপ্পনি সব গরু নির্ভর, মানে গোশত নির্ভর হয়ে পড়েছিল। অনেকটা ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মতোন, সব উত্তেজনা ঠেকেছে গরুতে। তবে আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিছুটা অন্যরকম। আমরা কোনো উত্তেজনাই বেশি সময় ধরে রাখতে পারি না। ধরে রাখার বিষয়টি আমাদের সঙ্গে ঠিক যায় না। যেমন গরু রেখে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মেতেছি ভারতীয় গায়ক ‘সনু নিগমে’র আজান বিষয়ক বক্তব্য নিয়ে। ‘আজানে’র সিড়ি বেয়ে আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে এখন ‘সনু নিগম’। ‘সনু নিগম’ ঠিক পথেই এগিয়েছেন। আমাদের দেশ হোক ভারত বা আমেরিকা হোক এখন ইসলাম নিয়ে কথা বললেই ‘হিট’। পড়তি ক্যারিয়ারের সনু নিগম ‘যোগী যুগে’ সঠিক তরিকাই বেছে নিয়েছেন। পড়তি ক্যারিয়ারটিকে চলতি করতে এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কী আছে। আমাদেরও কেউ কেউ এ নিয়েই খেয়েপরে বেঁচেবর্তে আছেন।
কথা বলছিলাম গরুর গোশত নিয়ে। চারুকলার ক্যান্টিনের বিষয়টি আপাতত ঢাকা পড়ার পথে। বিশেষ করে দৈনিক যুগান্তর, ইত্তেফাক খবরের পেছনের ঘটনায় ‘চাঁদাবাজি’র বিষয়টি আবিষ্কার করাতেই অনেকে রণে ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন। তবে একটা কথা ঠিক অনেক ছোট ঘটনাও কিন্তু দৃষ্টিপাতের অনেক বড় জানালা খুলে দেয়। চারুকলার ঘটনাটি তেমনি। আমাদের দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা শতকরা কত ভাগ? অনেকে বলেন, নব্বই ভাগের উপর, কেউ বলেন পঁচানব্বই। সে যাইহোক সংখ্যা বিচারে সম্প্রদায়গতভাবে মুসলিমরা যে অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হিসাবেই গরুর গোশত মুসলমানদের অন্যতম পছন্দের খাবার হওয়াতে তার সহজলভ্যতাই বাস্তবতার নিরিখে স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত চিত্র কী? তবে এ নিয়ে মূল আলাপে যাবার আগে নিজের জেলা থেকে ঘুরে আসি। চোখ বুলাই বাংলাপিডিয়ায় শেরপুর জেলার জনসংখ্যার দিকে। মাশাআল্লাহ, পপুলেশনে আমরা পিছিয়ে নেই। প্রায় সাড়ে ১৩ বর্গ কিলোমিটার মাটিতে আদম সন্তানের সংখ্যা ১৩ লক্ষের কাছে।
কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি কিন্তু আমার লেখার প্রতিপাদ্য নয়। মূল প্রতিপাদ্য হলো গরুর গোশত। কিভাবে তা বলার শুরুতেই নিজ শৈশবের গরুর গোশত বিষয়ক একটি স্মৃতির কথা বলি। আমার এক মামা সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন শেরপুর শহরেই। ‘মামা’র হোটেল বলে কথা। টেবিলে বসতেই বেয়ারার বিনীত জিজ্ঞাসা, কী খাবো, মুরগী না খাসি? আমি বললাম, গরু। বেয়ারা অপ্রস্তুত। মামা জানালেন এখানকার হোটেলে গরুর গোশত রান্না হয় না। কেন? এমন প্রশ্নে মামার উত্তর ছিল, ‘শেরপুরে অনেক হিন্দুলোক বাস করেন। গরু খাওয়া তাদের নিষেধ বলে হোটেলগুলোতে গরুর গোশত রান্না হয় না’। যৌবনেও কলেজে ঢোকা সদ্য তরুণ, সমাজ বদলের রাজনীতির অনুরক্ত, তখনো ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির তেমন প্রচলন হয়নি বলে বলি অসাম্প্রদায়িকতার কথা। হোটেলে বসে ‘সংখ্যালঘুদে’র নিষিদ্ধ খাদ্য ‘অধিকার’ প্রশ্নে নিজের জন্যও ‘অস্পৃশ্য’ মনে করি, গর্ব করি জেলার হোটেলগুলোতে গরুর গোশত রান্না হয় না বলে। নস্টালজিয়া থাক। বর্তমানে ফিরি। জনসংখ্যা বাড়লেও শেরপুরে সম্প্রদায়গত আনুপাতিক হার খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জেলা ছেড়ে অন্যত্র গেলেও জেলায় দুর্গাপূজায় প্যান্ডেলের সংখ্যা বেড়েছে। এখন পূজায় রাতের শেরপুর আরও বেশি ঝলমলে হয়ে ওঠে। এখনো দুর্গাপূজা জেলায় উল্লেখযোগ্য উৎসব; যার প্রাচুর্য্য, সাজসজ্জা গর্ব করে বলার মতোন।
উৎসব বর্ণনাও থাক। আসি জনসংখ্যা বিষয়ে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, শেরপুরে মুসলিম ১২৩৪৮৩৪, হিন্দু ৩৪১১২, বৌদ্ধ ৯৩১৪, খ্রিস্টান ৩৯ এবং অন্যান্য ১২৪৩ জন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে বারো লাখ মুসলিমের বিপরীতে, হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায় মিলিয়ে সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের গ-িও পেরোয় না। কিন্তু সংখ্যাধিক্যে কাউকে ছোট করা, নিজেকে ছোট করার সামিল। নিজের শিক্ষা, রুচিকে অসম্মান করার সামিল। এটাই সাম্যবাদের শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা এদেশের মানুষ লালন করছে যুগযুগ ধরে। আর সে কারণেই এখনো জেলার হোটেলগুলোতে গরুর গোশত রান্না হয় না। আর সম্প্রতি যে অল্প দু-একটিতে হয় তার সাইনবোর্ডে পরিষ্কারভাবে সেটার জানান দেওয়াই থাকে। হয়তো সব জেলার চিত্র এক রকম নয়, কিন্তু যেখানে নয় সেখানেও অনেক হোটেলে লেখা থাকে ‘নো বিফ’ কথাটি। সংখ্যায় কম হলেও পরধর্মের মানুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য, তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থানের সমতা আর গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই এটা করা হয়। আর এটাই সত্যিকার অসাম্প্রদায়িকতা।
সুতরাং এমন সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক দেশে যারা নানান ছলছুতায় কথিত ‘সেক্যুলার মাস্টার’ সাজতে চান, তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছু তো বোধ হওয়ার কথা নয়। আর এমন কজন ‘ঘোড়েল’ মাস্টারের বিপরীতে যারা কোমর বেঁধে ধর্ম রক্ষার ‘মাস্টার’ হতে যান, তাদের জন্য যে আরও করুণা হয়। আমি সাম্প্রদায়িক সংঘাত বলি না, বলি হাঙ্গামা। আমাদের দেশে যে কতগুলো এমন হাঙ্গামা হয়েছে সবগুলোর পেছনেই রয়েছে, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ, ধর্ম নয়। সম্প্রতি নাসিরনগরই তার প্রমাণ। আর এসব হাঙ্গামার ‘অফ স্ক্রিন’ মেকার হলো সেই কথিত ‘মাস্টার’রাই।
ইদানিং ‘অফ স্ক্রিন’ খেলা তেমন জমছে না বলেই হয়তো সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ভর করেছেন এসব ‘মাস্টার’রা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘কোরাস গাইয়ে’ ফ্যান-ফলোয়ারগণ। বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া তথা ‘ফেসবুক’ এখন আর যেনতেন ব্যাপার নয়। সারাবিশ্বে ‘ফেসবুক’ ব্যবহারে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। কাজ না থাকলে যেমন জনসংখ্যা বাড়ে, তেমনি ‘ফেসবুকার’দের সংখ্যাও হয়তো বাড়ে। এক ‘মিডিয়া মাস্টারে’র কথা বলি। বৈদেশ ভ্রমণকালে ফেসবুকের ‘ওয়াইন বারে’র ছবি পোস্ট করেছিলেন একজন। সেই ছবির ব্যাপারে মন্তব্যে একজন তাকে মদ খেতে বারণ করলেন এবং বললেন, ইসলামে মদ খাওয়া হারাম। বললেন কী মরলেন। অসাম্প্রদায়িক ‘মাস্টার’রা পেয়ে বসলেন, সেই ‘মিডিয়া মাস্টার’ লিখলেন, ‘একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ কী খাবে না খাবে তার উপর খবরদারি করা শিক্ষা ও সংস্কৃতিহীনতার পরিচায়ক’। কথা কিন্তু অযৌক্তিক নয়। কিন্তু গোলটা বাঁধলো তখনি যখন তিনি চারুকলার ক্যান্টিন বিষয়ে বললেন, ‘ওখানে হিন্দু ছাত্ররাও থাকে সুতরাং গরু নিষিদ্ধ থাকাই ভালো’। তিনি কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মনে করলেন কি না ঠিক বুঝলাম না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো সংকীর্ণতামুক্ত আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা। ব্যতিক্রম হয়তো থাকতে পারে কিন্তু ব্যতিক্রম কোনো উদাহরণ নয়। এমন একটি জ্ঞানপীঠের ছাত্রাবাসে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর প্রচলিত এবং পছন্দের খাবার রান্না হবে না এমন তো হবার কথা নয়! যদি হয় তাহলে এর চেয়ে বড় সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা আর কিছু হতে পারে না। এমন কর্মকা-ই মূলত সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। যেমন পাশের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের কটি জায়গায় গরুর গোশত নিয়ে যা ঘটছে তা কোনোক্রমেই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না এবং সভ্যতার সঙ্গে যায় না। ‘সেক্যুলার’ দাবিকৃত দেশটিতে গরুর গোশত সংরক্ষণের গুজবে মানুষ হত্যা করা হয়, গণমাধ্যমের এমন খবর সত্যিই বিস্মিত করে, বিষাদিত করে। অথচ সংখ্যাধিক মানুষের মধ্যে পরের জন্য শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কোনো নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন পড়ে না, যেমন পড়ে না আমাদের দেশে। এখানে পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই হোটেলে গরুর গোশত রান্না হয় না, অন্তত জানান দেওয়ার জন্য ‘নো বিফ’ টানানো থাকে। আর এটাই আমাদের দেশের আবহমানকালের শিক্ষা। অথচ চারুকলার ক্যান্টিনে গরুতে অলিখিত নিষেধের ব্যাপারটি আমাদের সেই আবহমানতার সঙ্গে যায় না। জোরজবরদস্তির এমন বিষয়ে ‘মিডিয়া মাস্টার’ সেই সেক্যুলারজনের ভাষাতেই বলি, ‘একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ কী খাবে না খাবে তার উপর খবরদারি করা শিক্ষা ও সংস্কৃতিহীনতার পরিচায়ক’।
ফুটনোট: কিছু সাংবাদিক সনু নিগমের ফ্ল্যাটের সামনে ভোরে আজানের সময় জড়ো হয়েছিলেন সেখানে আজানের শব্দ শোনা যায় কি না সেজন্য। তাদের কানে কোনো আজানের শব্দ পৌঁছেনি। এমন খবরটি দিয়েছে স্বয়ং বিবিসির হিন্দি ভার্সন। আমাদের কেউ সনুর সমর্থনে বলেছেন, সনু তার ব্যক্তিগত মতপ্রকাশ করেছেন, তাতে দোষের কী? মূল লেখার শুরুতেই বলেছি সনু নিগম কেন এটা করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের যারা সনুর কোরাস ধরেছেন তাদের ক্যারিয়ারও কী সনুর মতোন পড়তির দিকে?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান