নবীপ্রেম
আহমদ আবদুল্লাহ
রাসুল (সা.) এবং হজরত আবু বকর (রা.) একসঙ্গে গভীর রাতে ঘর থেকে বেরোলেন। হজরত আবু বকর (রা.) পূর্ণ এক রাত একদিন বাহনজন্তুর ওপর চড়ে থাকলেন। হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, দুপুরবেলা রোদে চলতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিলো, তাই খানিকটা বিশ্রাম নেয়ার জন্য আশপাশে তাকালাম। খুঁজতে লাগলাম একটুখানি ছায়া। কিন্তু কোথাও মিললো না তেমন জায়গা। হঠাৎ দূরে ছোট্ট একটি পাহাড় দেখে দ্রুত ছুটে গেলাম সেদিকটায়। দেখলাম তাতে ছায়ার কিছু অংশ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। সেই ছায়াটুকুতে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর অবস্থানের জন্য সেখানে একটি পশুর চামড়া বিছালাম। এরপর বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! শুয়ে পড়ুন এখানে।’ রাসুল (সা.) শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণপর এদিকওদিক লক্ষ্য করলাম। হঠাৎ একজন রাখাল নজড়ে পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে বালক! তুমি কার মেষপাল চরাও?’ বললো, ‘কুরাইশের এক ব্যক্তির।’ সে এমন ব্যক্তির নাম বললো, যে আমার পূর্বপরিচিত। বললাম, ‘তোমার মেষপালে দুধ আছে?’ বললো, ‘আছে।’ বললাম, ‘তুমি আমার জন্য একটুখানি দুধ দোহন করবে?’ হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো সে। এরপর তাকে একটি ছাগল বাঁধতে আদেশ দিলাম। তারপর আমি তার স্তন থেকে ধুলো মুছতে বললাম। সে যথাযথভাবে সব আদেশ পালন করলো। দুধের পেয়ালা এগিয়ে দিলাম। বালকটি বেশখানিক দুধ দোহন করে দিলো। আমি পেয়ালায় জল ঢেলে তার তলা ঠা-া করে নিলাম। এরপর রাসুল (সা.) এর কাছে এসে দেখি, তিনি জেগে আছেন। বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! নিন, দুধ খান।’ তিনি তৃপ্তিভরে খেলেন। সেটা দেখে আমিও তৃপ্তিবোধ করলাম। রাসুল (সা.) আবার রওনা করলেন। আমিও ধীরগতিতে এগোতে লাগলাম। এদিকে কুরাইশরা তখনও আমাদের অনুসন্ধানে ব্যস্ত। তাদের মধ্য হতে একজন ঘোড়সওয়ার সুরাকা ইবনে মালিক আমাদেরকে দেখে ফেললো। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এখন কি হবে আমাদের? একজন সন্ধানকারী আমাদের সন্ধান পেয়ে গেছে।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ সুরাকা আমাদের দিকে অনেকটা এগিয়ে এলো। এতোটা কাছে যে, আমাদের আর তার মাঝে একটি বা দুটো বর্শার ব্যবধান। আমি আবার বললাম, ‘হে আল্লার রাসুল! এই যে সন্ধানকারীরা আমাদের সন্ধান পেয়ে গেছে।’ তখন আমার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কাঁদছো কেনো?’ বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! আমি নিজের জন্য নয়, কেবল আপনার জন্য কাঁদছি।’ পরিস্থিতি সামাল দিতে রাসুল (সা.) হাত তুললেন আল্লাহর দরবারে। বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে চাও, সুরাকাকে প্রতিহত করো।’ তৎক্ষণাৎ তার ঘোড়ার পা মাটি গ্রাস করে নিলো। সুরাকা ঘোড়ার পিঠ থেকে দ্রুত নেমে পড়লো। সুরাকা বললো, ‘মুহাম্মদ! আমি বুঝে গেছি, আপনি আমার জন্য বদদোয়া করেছেন। দয়া করে আপনি আমার জন্য প্রার্থনা করুন, যেনো এমন দুর্দশা থেকে রাব্বুল আলামিন আমায় রক্ষা করেন। আল্লাহর শপথ! আমি কারো কাছেই আপনাদের খবর প্রকাশ করবো না। এগুলো আমার তীরধনুক। এখান থেকে ইচ্ছেমতো নিয়ে নিন। কিছুদূর এগোতেই আমার উট এবং মেষপাল পাবেন। তা থেকে যে ক’টা দরকার, নিয়ে নেবেন। তবু আমার এ বিপদ থেকে মুক্তির জন্য একটুখানি প্রার্থনা করুন। ’ প্রিয়নবী (সা.) বললেন, ‘এসবের কোনোকিছুরই প্রয়োজন নেই।’ রাসুল ( সা.) সুরাকার জন্য দোয়া করলেন। সে আগের অবস্থায় ফিরে এলো। সুরাকা সঙ্গে সঙ্গে তার দলবলের কাছে ফিরে গেলো। এরপর রাসুল ( সা.) চলতে লাগলেন।
আমিও তার সঙ্গে ধীরে ধীরে হাটতে লাগলাম। অবশেষে মদিনায় এসে পড়লাম। মদিনাবাসী দিকদিগন্ত থেকে ছুটে এলো। সবাই রাস্তায় এসে প্রিয়নবী (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানালো। ছোট্ট ছোট্ট শিশুকিশোর সুরে সুরে তালে তালে বলতে লাগলো, ‘আল্লাহু আকবার, রাসুলুল্লাহ এসেছেন, মুহাম্মদ এসেছেন, প্রিয়নবী এসেছেন।’ তাঁর আতিথ্য নিয়ে মদিনাবাসীর মাঝে প্রতিযোগিতা লেগে গেলো। প্রিয়নবী (সা.) বললেন, ‘আজ রাত আবদুল মুত্তালিবের মামাবাড়ি বনু নাজ্জারের ঘরে কাটাতে চাই। পরদিন মহান রাব্বুল আলামিন যেদিকে নির্দেশ দিলেন, সেদিকে রাসুল (সা.) চলে গেলেন। (বোখারি : ৩৬১৫)।