শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য : দায় কার?
মো. ওসমান গনি
শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি নাগরিক যাতে শিক্ষা লাভ করতে পারে সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে বাণিজ্যকরণে রূপ নিয়েছে। যার কারণে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারছে না। বছর বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তিসহ বাড়তি ফির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এসব পরিবার সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে বেশ বিপাকেই রয়েছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ হারাচ্ছে তারা। এর ফলে শিক্ষা বৈষম্য বাড়ছেই। মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তিসহ বাড়তি ফি নেওয়ার অভিযোগে হৈচৈ একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও বেতন ফি বাড়তি নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্যকর কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী অভিভাবকদের। শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণে বাড়ছে বৈষম্য। ধনী-গরিব সবার শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পেশিশক্তির কাছে কেন শিক্ষা প্রশাসন মাথানত করবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার এবং আংশিক এমপিওভুক্ত ও এমপিওবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা। তবে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে সেশন ফি, উন্নয়ন ফি ও মাসিক বেতনসহ সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এ নীতি মানছে না কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নানা ছলচাতুরিতে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়তি ফি আদায় করছে। প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবাদ করলে ছাত্রদের ওপর চলে নির্যাতন আর পরীক্ষার সময় খাতায় নম্বর দেন কম বলে অভিভাবকদের অভিযোগ। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। সারা বছরই শিক্ষাক্ষেত্রের অনিয়ম নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও কোনো পরিবর্তন আসছে না। প্রতিষ্ঠান চলছে নিজেদের মতো। অভিভাবক ও ছাত্র-ছাত্রীরা কতিপয় শিক্ষকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তাই মন্ত্রণালয় মনিটরিং করলে অভিভাবকরা উপকৃত হবে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এবং গত বছরের জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন স্কুলের বিরুদ্ধে বাড়তি ফি আদায়ের অভিযোগ ওঠে। অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণার পর সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়তি ভর্তি, সেশন ও টিউশন ফি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হৈচৈ, তুঘলকি কা- ঘটে। এর প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলেন অভিভাবকরা। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। এতে বলা হয়, বেসরকারি স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও টিউশন ফি ৩০ শতাংশের বেশি বাড়ানো যাবে না। বাড়তি ফি আদায়ের আগে শিক্ষা প্রশাসনের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু তারা তা মানছে না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীরণ করে মোটা অংকের টাকা রোজগার করা। তা ছাড়া কোচিং ও প্রাইভেট সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অধিকাংশ সময় প্রাইভেট ও কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। প্রাইভেট ও কোচিং এ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। যার কারণে গরিব ও অসহায় লোকদের ছেলে-মেয়েরা টাকার অভাবে প্রাইভেট ও কোচিং করতে পারে না। যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট বা কোচিং করে না সে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের তেমন কোনো খেয়াল থাকে না। পরীক্ষার সময় তাদের পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেওয়া হয় কম এমন অভিযোগ প্রায়শ্চ শোনা যায়। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। তখন অনেক ছেলে-মেয়ে বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অবস্থা বিরাজ করছে ইচ্ছা থাকলেও সকল ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারবে না শুধু টাকার অভাবে। বর্তমানে যাদের হাতে অঢেল টাকা পয়সা আছে শুধু তাদের ছেলে-মেয়েরাই লেখাপড়া করা সম্ভব। শিক্ষাক্ষেত্রের এ বৈষম্য দূর করা জরুরি। দেশের প্রতিটি শিশুই যেন লেখাপড়া করতে পারে সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান