এই অসীম ক্ষমতার উৎস কোথায়?
এ.টি.এম গোলাম কিবরিয়া
কাশ্মীরের ভারতীয় সেনাদের অন্যায় নিয়ে যখনই কোনো ভারতীয় প্রশ্ন তোলে, তাদের সেই প্রশ্ন সামাল দেওয়ার জন্য সেনাদের কিছু বলা লাগে না। বিজেপির পা-ারা বলা শুরু করে, ‘জওয়ান বর্ডার পে লাড়ড়েহে হ্যায় ওর আপলোগ…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অরুন্ধতি রায় একবার বলেছিলেন, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছদ্য অংশ না। তাতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছিল। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে বলা হয়েছিল যে, তিনি পাকিস্তানের দালাল। পাকিস্তানে আপনি যদি বেলুচিস্তান নিয়ে কিছু বলেন, সঙ্গে সঙ্গেই আপনি ভারতের দালাল ট্যাগ খেয়ে যাবেন। সাধারণত দেশের জন্য সেনাবাহিনী লাগে, কিন্তু পাকিস্তান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সেনাবাহিনীর জন্য দেশ আছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের রেইজন দ্য’তর হচ্ছে তাদের মিলিটারি। এ কারণেই একাত্তরের এট্রোসিটি নিয়ে ক্ষমা চাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেনাপ্রধান কায়ানীর গাড়িবহর যাবে বলে রাস্তায় নওয়াজ শরীফের গাড়িবহরকে দাঁড়ায়া থাকতে হইতো। দেশপ্রেম ও মিলিটারি ম্যাসকুলিনিটি এক ধরনের ভয়েরিস্টিক প্লেজার দেয় বলদকুলকে। দেশপ্রেম এক ধরনের মর্দামি, কম থাকা মানে আপনি যথেষ্ট পুরুষ না, এইভাবে ভাবতে বাধ্য করা হবে আপনাকে। বিজেপি ক্ষমতায় আসলে সেভেন সিস্টার, কাশ্মীরে হামলাকে যেভাবে জাস্টিফাই করে, সেভাবে। এটা ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, বাংলাদেশ সবখানেই সত্য।
বেলুচিস্তানে ভারতের ইন্ধন আছে, কাশ্মীরে ও পাকিস্তানি ইন্ধন আছে। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই দখলদারি জায়েজ হয় না। কজেশন ও কো-রিলেশন এক জিনিস নয়। দখলদারদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের আন্দোলন ন্যায্য, সেটা পূর্ব পাকিস্তান কাশ্মীর বেলুচিস্তান, ফিলিস্তিন এবং বাংলাদেশ যেখানেই হোক না কেন।
জাতিরাষ্ট্রগুলো যখন বানানো হয়, তখন বেশকিছু পকেট তৈরি হয়ে গেছে, যারা আসলে ফিট ইন করে না। এইটা পুরা দুনিয়াতেই হয়েছে এবং এইটা একটা বাস্তবতা। এই পকেটবাসীদের স্বাধিকারবোধ আপনি কোনোদিন দমাতে পারবেন না। এরা কোনোদিনই পোষ মানবে না। হিউম্যান ইন্সটিঙ্কট এইগুলো। চাল্লু হইলে, ধীরে ধীরে এসিমিলেট করবেন, যেইটা বাংলাদেশ রাষ্ট্র করে পলিসি লেভেলে। আপনি ট্যুরে যান পাহাড়ে, অবকাশ যাপন করেন, টেলিকমের অ্যাডে দেখা যায় পাহাড়ি ‘এক্সোটিক’ ললনারা মোবাইল ফোন হাতে নিয়া আমাদের আধুনিকতার যাত্রায় শরিক হয়। সিভিলাইজিং মিশন ও অন্যান্য। কালচারাল এসিমিলিজমের চূড়ান্ত! শুধুই লাঠিয়াল দিয়ে পারবেন না। এরা হুটহাট মানুষ মাইরা ফেলবে তখন মিলিটারি ম্যাসকুলিনিটির পূজারী ফেবু সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে ফকিরহাটের আবুল ও স্ট্যাটাস দিবে ঢ়ধযৎর শঁঃঃধ নধংংধ নযধৎধঃধৎ ফধষধষ.
ফেবু বিএনপি ওয়ালাদের আর্মি ফেটিশ মারাত্মক। এইটা বোধহয় জেনারেল জিয়ার উর্দির কারণে। পাহাড়ে মিলিটারির যাবতীয় টয়লেট সাফ করার জন্য তারা হাতে টিস্যু নিয়া দাঁড়ায়া থাকে। এইটা একটা ট্র্যাপও। আওয়ামী সুশীল লীগ এই কথাটাই বলে, বিএনপিকে মিলিটারির সঙ্গে সিনোনিমাস করে। বিএনপি সেইটাকেই রি-ইনফোর্স করে। জিয়ার বিএনপি আর বর্তমান বিএনপি এক না, কিন্তু আনপ্রোডাক্টিভ ব্যাগেজগুলা ধইরা রাখতে বলদকূল এক পায়ে খাড়া। আওয়ামী লীগ এরশাদের সঙ্গে ছিয়াশিতে নির্বাচনে যায়, এখন বিশেষ দূত বানায়, জেনারেল মইনের সঙ্গে কোলাকুলি করে, কিন্তু সুশীলদের কাছে তারা এন্টি আর্মি। এইটা বাংলাদেশের রাজনীতির একটা প্যারাডক্স বটে।
সকল রাষ্ট্রের পর্দার আড়ালেই আর্মি দাঁড়ায়া থাকে। আপনি তাকাইলে পর্দার নিচ দিয়া তার বুট দেখতে পাবেন। সুসভ্য রাষ্ট্রগুলোতে সে কোণায় থাকে, নজরে আসে না। আর্মি মানেই এভিল ধরনের চিন্তা করা কাউন্টার প্রোডাক্টিভ। বাস্তবসম্মত না এই পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রীক বিশ্বকাঠামোতে। একটা দেশের মিলিটারি হরেদরে সেই দেশকেই রিপ্রেজেন্ট করে। কিন্তু যার ক্ষতি করার ক্ষমতা বেশি, তাকেই সবচেয়ে বেশি চেক-এ রাখতে হয় গণতন্ত্রে। এইটা কমনসেন্স। তার বিরুদ্ধেই বেশি কথা হবে এবং দেখা যায় যে বলার পরেও কিছু হয় না। এই যে ধরেন তনু নামের মেয়েটা, যে বিচারই পাইল না শেষতক। সবাই জানে কারা মারছে, কিন্তু লাভ হয় না। তনু হত্যার বিচার করাইতে পারলে আজকে রমেলের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ত।
এই কারণেই বলতে হবে বারবার। সঙ্গে এইটাও বলতে হবে, এই অসীম ক্ষমতার উৎস কোথায়? উৎস অনির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে, যারা তাদের অবৈধ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে এদের ঘাঁটায় না, থোকবরাদ্দ দিয়া হ্যাপি রাখে। পোস্ট কলোনিয়াল কান্ট্রিগুলোর আর্মি এমনিতেই রাষ্ট্রের অন্যান্য অর্গানগুলোর তুলনায় বেশি শক্তিশালী থাকে। তার উপরে অনির্বাচিত ক্ষমতার স্টেকহোল্ডার। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ভাগিদার। জমিদারের ক্লিনচিট পাওয়া। অত্যচারী জমিদারের লাঠিয়াল কিভাবে মোলায়েম হবে?
পাহাড়ে আমাদের সেনারা অত্যাচার করে, করে আসতেছে বহুবছর ধরে। সেটলার কলোনিয়ালিজমের পাহারাদার তারা। আইয়ূব-মুজিব-জিয়া-এরশাদ থেকে আজ পর্যন্ত। এইটা জ্বলন্ত সত্য। স্বীকার না করা নিষ্ঠুরতা। আপনি আইয়ূব এরশাদের জমানার লোক না। রাস্তাঘাটে চুল বড় ক্যান বইলা আর্মির থাবড়া খাওয়া লাগে নাই আপনার। মার্শাল ল অস্বীকারকারী মোরগঝুঁটির মতোন চুল আপনার, আপনার মেরুদ- আরেকটু শক্ত হওয়া উচিত। আপনার আর্মি ফেটিশ আরও কম হওয়া জরুরি।
কয়েকদিন আগে মারা যাওয়া পোলিশ সমাজতাত্ত্বিক জিগম্যান্ট বাউম্যান ছিলেন হলোকাস্ট সার্ভাইভার। তিনি একবার বলছিলেন, গণহত্যা বিস্মৃত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে না আসলে, ঝুঁকিটা হলো গণহত্যার উপরে সমাধিসৌধ বানায়ে ভবিষ্যত পাপগুলো তাতে শামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অখ-তা, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার লালসালু দিয়ে লাশ হয়তো ঢেকে দেওয়া যাবে, দুর্গন্ধ ছড়ানো তাতে বন্ধ হবে না।
লেখক: কলামিস্ট/ফেসবুক থেকে