সেম টু ইউ
কিযী তাহনিন
টইঊজ-এর কল্যাণে এ কয়েক মাসে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, আমার স্কুল-কলেজের পড়াশোনা কিন্তু মার খেয়ে যাচ্ছে। সেদিন যার টইঊজ উঠলাম, সেই ভদ্রলোকের বয়স ৫০ কিংবা ৬০-এর ঘরে। ধরে নিই তার নাম মোতালেব সাহেব। যাকে দেখে আমার মনে হলো, এ জীবনে তার একমাত্র সার্থকতা তিনি টইঊজ চালাচ্ছেন। কিন্তু আমি যে সম্পূর্ণ ভুল, তা বুঝলাম খানিক পরেই। লম্বা পথ, তার চেয়ে লম্বা জ্যাম। সময় কাটানোর জন্য এই সেই প্রশ্ন করলাম। কথোপকথন চলছিল। মোতালেব, ‘তো প্রায় ৩ মাস হলো টইঊজ চালাই। তার আগে এক রেস্টুরেন্টের বিদেশি মালিকের গাড়ি চালাতাম। আমি ইংরেজি বলতে পারি। তাই সমস্যা হতো না।
কৌতূহলী আমি। প্রশ্ন করলামÑ ‘তারপর?’ মোতালেব, ‘সব ভালোই ছিল। মালিকের ভাইয়ের একটু সমস্যা।’ আমি চুপ। মোতালেব, ‘১২-১৪ ঘণ্টা ডিউটি করায়। বয়স হইসে। তাও করতাম, কাজ তো করতে হবে। সব ঠিকই ছিল, কিন্তু…’ আমি, ‘ওহ, এই জন্য চাকরি ছাড়লেন? কিন্তু টইঊজ এও তো অনেক পরিশ্রম।’ মোতালেব, ‘নাহ, ওই জন্য ছাড়িনি। কারণ অন্য।’ বুঝলাম, গল্প জমে উঠেছে। আমি চুপ। মোতালেব, ‘একদিন মালিকের ভাই গাড়িতে উঠল, রেস্টুরেন্ট এর রান্নার সব কাঁচামাল নিয়ে।’ আমি, ‘আচ্ছা।’ মোতালেব, ‘গাড়িতে এত মালের তো জায়গা হয় না। তার মধ্যে ময়দার প্যাকেট ছিড়ে পুরা গাড়ি ময়দায় সয়লাব। পরিষ্কার করতে জান বাইর হইয়া যাবে। আমি তাই ইংরেজিতে আদবের সঙ্গেই কইলামÑ স্যার এ গাড়িতে তো এত জিনিস আটব না।’ আমি একটু নড়ে চড়ে বসে, মনোযোগকে ঠিকঠাক গুছিয়ে নিলাম। মোতালেব, ‘মালিকের ভাই খুব রেগে গেল। ইংরেজিতে না বইল্যা তাদের দেশের ভাষায় আমারে অনেক্ষণ কি কি যেন বলে গেল।’ আমি, ‘তারপর?’ মোতালেব, ‘তাদের দেশের লোকাল ভাষা তো আমি বুঝি না। কি উত্তর দিই। গালি দিল নাকি ভালো বলল তাও বুঝলাম না। অনেক চিন্তা করলাম। উনার কথা শেষ হবার পর শুধু তিনটা শব্দ কইছিলাম। তারপর আমার আর চাকরি থাকেনি।’ আমার চোখ বড় বড় করে মোতালেব ভাইয়ের দিকে, তাকিয়ে আছি। নিঃশ্বাস ঘনঘন পড়ছে, বুঝতে পারছি। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম, ‘কোন তিনটা শব্দ বলছিলেন?’
মোতালেব সাহেব হাসে। সাসপেন্স তৈরি করে। কিছুক্ষণের নীরবতা তৈরি করে।
তারপর বলে, ‘বলছিলাম, স্যার, আপনি আমারে ভালো কইলেন নাকি খারাপ কইলেন তা তো বুঝলাম না। তবেই যাই কইলেন, ‘ঝধসব ঃড় ণড়ঁ’। আমি অবাক বিস্ময়ে মোতালেব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি হাসে। বলেন, ‘আমি জানতাম আপা, এই তিনটা শব্দ বলার পর, আমি বুঝে যাব, উনি আসলে আমারে ভালো না মন্দ বলছেন।’ আমি আর কথা বাড়াইনি। মনের চিন্তার গ্রাফ এমন লম্ফঝম্ফ করছিল যে কথারা গতি হারাচ্ছিল। বিদায় নেবার সময় শুধু বলে এসেছিল, ‘আপনার থেকে আজ যা শিখলাম, আরও আগে শিখলে, হয়তো আমাদের সবার আরও উপকার হতো।’ ‘ঝধসব ঃড় ণড়ঁ’ শব্দ তিনটার এত অসাধারণ প্রয়োগ আমি আগে কখনো সত্যি শুনিনি। সেদিন থেকেই তক্কে তক্কে আছি, কবে সুযোগ আসবে, আমিও ঠিক সময়ে বেঠিক কাউকে বলে ফেলতে পারব, ‘ঝধসব ঃড় ণড়ঁ’
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান