ফাস্টফুড খেয়ে আমরা ক্রমশ সেøা হয়ে যাচ্ছি?
অরুণ কুমার বিশ^াস
নীলু ভাবির কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ। ছেলেটা তার বড় হচ্ছে, কিন্তু বেগ বাড়ছে না। মাত্র বারোতেই কেমন দশাসই দেখতে হয়েছে, সেই তুলনায় লাফ-ঝাঁফ নেই। নড়াচড়ায় গদাই লস্করি চাল, কেমন যেন পাইথনের স্বভাব পেয়েছে ছেলেটা।
ভাবির কথা শুনে হেসে ফেলি। তা যা বলেছেন, এই প্রজন্মের ছেলেপুলেরা কেমন অজগরের মতো বেড়ে উঠছে। আরেকজন সখেদে বলল, বাবুটা এমন ধীরস্থির! ঠিক যেন পোলট্রি মুরগি। শুনতে খারাপ শোনালেও পরিস্থিতি আদতে এমনই। বাচ্চারা সব ঘাড়েগর্দানে বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় তাদের এনার্জি বা চলমানতা বাড়ছে না। নেপথ্যে কী কারণ জানতে চাই এক পুষ্টিবিদের কাছে। তিনি গল্পচ্ছলে বললেন, ওরা খায় কী যে ছুটবে! আগে মেশিনের ভালো তেল ঢালুন, তারপর দেখুন তাগড়া ঘোড়ার মতো কেমন টগবগিয়ে ছুটছে।
কয়েকজনের কেসহিস্ট্রি জেনে নেওয়া যাক। এরা সব উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ছেলে-মেয়ে উভয়েই আছে। এরা দিনে অন্তত একবার ভরপেট ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খায়। এই তালিকায় পিৎজা-পাস্তা থেকে শুরু করে ক্লাব স্যান্ডুইচ, কিংসাইজ বার্গার, সিজকেক জাতীয় অনেক কিছু ভক্ষণ করে। এতে শুধু চর্বি নয়, আছে অস্বাস্থ্যকর আরও অনেক উপাদান। এমনও অনেকের গল্প জানা গেল, যারা নাকি রীতিমতো ফাস্টফুডে আসক্ত। ভাত দেখলে এদের চোখ কপালে ওঠে, নাসিকা কুঞ্চিত হয়। এদের মতে, মাছ-ভাত নাকি গোখাদ্য! ভাবুন একবার!
আরেক প্রজাতি আছে যারা ফাস্টফুডের পাশাপাশি রেস্তোরাঁয় খেতে পছন্দ করে। অর্থাৎ এদের ঘরে উনুন চড়ে না, হেঁসেলে কোনো রকম কাটাকুটি বাটাবাটি নেই। বাজারঘাট করার টাইম নেই, সো দে ডাইন আউট! ছোট্ট করে বললে, এরা সব ফুডি। ভরপেট জাঙ্ক সাঁটিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। যেহেতু গাড়িবান, তাই ছুটতে বা হাঁটতে হয় না। তাদের জীবন এভাবে আরাম আয়েশে গড়ে ওঠে। বয়স কুড়ি না পেরোতেই এক একজন ঢাউস সাইজের তেলের পিপের আকৃতি ধারণ করে।
প্রায়শ শোনা যায়, এসব রেস্তোরাঁয় অত্যন্ত নিম্নমানের ও পচাগলা জিনিস খাওয়ানো হয়। কুরবানির সময় সস্তায় গোশ কিনে রাখে হোটেলঅলারা। সারাবছর সেসব বিক্রি করে, আর ফুডিরা কপাকপ গিলে খায়। তেলাপোকা, টিকটিকি পাবার খবর কিন্তু মোটেও বিরল নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত টুকটাক জরিমানাও করে, কিন্তু তাতে ফাস্টফুড জেনারেশন মোটেও বিচলিত নয়। তারা প্রাণ দিয়ে হলেও খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখবে বলে পণ করেছে।
শুধু ছেলেপুলের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি এমন কয়েকজনকে জানি, যারা কিনা বাসায় রান্নার ক্লেশ স্বীকার করতে চান না বলে পরিবার নিয়ে নিয়মিত রেস্তোরাঁয় খান। তুমুল আড্ডা, সঙ্গে ভালমন্দ চাখেন। আবার সঙ্গে করে নিয়েও আসেন, যাতে পরদিন নাশতাটা এতেই চলে যায়।
এখানে আবার স্ট্যাটাস-সিম্বল ব্যাপারটাও খানিক এসে যায়। নিয়ম করে বাইরে খাওয়া নাকি সমাজে জাতে ওঠার দূরন্ত সিঁড়ি। যে সে লোক তো আর দামি রেস্তোরাঁয় খাবার ‘কস্ট’ সামলাতে পারে না! স্ট্যাটাস সামলাতে গিয়ে যে শারীরিক কষ্ট হয়, সেটা কিন্তু এরা স্বীকার করবে না। একটু ভাবুন তো, হোটেল-রেস্তোরাঁয় যেসব খাবার সার্ভ করা হয় তা কী তেল দিয়ে রাঁধে! নিশ্চয়ই অতিশয় মূল্যবান জলপাই তেলে নয়। বরং সস্তায় কেনা পাম অয়েল ব্যবহারের সম্ভাবনাই বেশি যাতে নাকি প্রায় আশিভাগ সম্পৃক্ত অর্থাৎ ক্ষতিকর চর্বি বিদ্যমান। এসব খেয়ে আপনার সন্তান অজগরের মতো গড়াবে না তো কি পাখির মতো উড়বে!
প্রসঙ্গত বলা যায়, যারা কি না জাঙ্কফুড আসক্ত, এরা স্বভাবতই আড্ডাবাজ হয়। একা একা খেয়ে তেমন সুখ নেই, সঙ্গে বন্ধু বা বন্ধুনী থাকলে জমে ভালো। আড্ডা ঘরোয়া ব্যাপার। ফলে এরা হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলার সময় পায় না। খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমায়। বিকেল বেলাটাই খানাপিনার মোক্ষম সময়, যখন কি না ছেলেপুলেদের খোলা মাঠে বেড়ানো বা খেলাধুলা করা উচিত। প্রশ্ন এসে যায়, খেলবে যে, মাঠ কোথায়! এটা অবশ্য মেয়রগণ ভালো বলতে পারবেন। আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়।
শেষত, শরীর সুস্থ ও মন ভালো রাখতে চাইলে অযথা ফাস্টফুড খাওয়া বন্ধ করতে হবে। জাঙ্কফুড মোটেও স্বাস্থ্যকর বা উপাদেয় নয়। সময়ে জিভ সামলাতে না পারলে শরীর ও সম্মান দুটোই যাবে। অযথা কথা বলা যেমন বিপদ ডেকে আনে, তেমনি নিয়মিত ফাস্টফুড খেলে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান